সেই ঝুলনের কন্ঠে বাজছে ঠিকাদারের গীত, চট্টগ্রামে ২৬০ কোটি টাকার প্রকল্প ঘিরে বড় লুটপাট

বিজ্ঞাপন দিয়ে ঠিকাদারের পক্ষে সিটি কর্পোরেশন কর্মকর্তার সাফাই

চট্টগ্রাম নগরীর ৭৫ কিলোমিটার সড়কে এলইডি বাতি লাগানোর জন্য চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) বিদ্যুৎ উপবিভাগ প্রায় ৪২ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেয় এইচটিএমএস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। এর মধ্যেই চসিকের ১৩তম সাধারণ সভায় অভিযোগ ওঠে, প্রকল্পের ঠিকাদার যেসব বৈদ্যুতিক পোল, ক্যাবল, লাইট এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি লাগাচ্ছেন, তার প্রায় সবই নিম্নমানের। ঠিকাদারের নিম্নমানের কাজের এমন গুরুতর অভিযোগ পেয়ে তদন্তের সিদ্ধান্ত দেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। চসিকের গঠিত কমিটি অভিযোগের সত্যতা পেয়ে নিম্নমানের কাজগুলো নতুনভাবে করার ও ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে।

এবার সেই তদন্ত প্রতিবেদনের গুণগত মান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে ‘তথ্যগত ভুল’ দাবি করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছেন ২৬০ কোটি টাকার এলইডি বাতি প্রকল্পের পরিচালক ও সংস্থাটির প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ। অথচ এমন ব্যয়বহুল বিজ্ঞাপন দেওয়ার ব্যাপারে সিটি কর্পোরেশনের অনুমোদনই নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। খোদ সিটি কর্পোরেশনের ভেতরেই এখন গুঞ্জন চলছে— ঠিকাদারের নিম্নমানের কাজ নিয়ে তদন্ত হওয়ার পর সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশলী কেন আগবাড়িয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে চলেছেন?

সিটি কর্পোরেশন সূত্র বলছে, জাইকার অর্থায়নে নগরীর ৭৫ কিলোমিটার সড়কে এলইডি বাতি স্থাপনে চারটি প্যাকেজে ৪১ কোটি ৮৩ লাখ টাকায় এইচটিএমএস লিমিটেডকে ২০২০ সালের ১৪ মে কার্যাদেশ দেয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বিদ্যুৎ উপবিভাগ। চসিকের ১৩তম সাধারণ সভায় অভিযোগ করা হয় প্রকল্পের ঠিকাদার দ্বারা স্থাপিত বৈদ্যুতিক পোল, ক্যাবল, লাইট এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি নিম্নমানের।

এমন গুরুতর অভিযোগ ওঠার পর তা তদন্তের সিদ্ধান্ত দেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। চসিকের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. কামরুল ইসলামকে আহ্বায়ক, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মাঈন উদ্দীন জুয়েল এবং মেয়রের একান্ত সচিব আবুল হাশেমকে সদস্য করে ওই তদন্ত কমিটি করা হয়। এর প্রেক্ষিতে গঠিত তদন্ত কমিটি গত জুন মাসে প্রতিবেদন জমা দেয়।

কমিটি সরেজমিন পরিদর্শন ও টেস্ট রিপোর্ট যাচাই করে সুস্পষ্টভাবে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ‘স্থাপিত ক্যাবলের মান মোটেও সন্তোষজক নয়। বৈদ্যুতিক পোলের জন্য যে মানের বেইজ (সিসি) টেন্ডার ডকুমেন্টের স্পেসিফিকেশনে ধরা হয়েছে তা রাস্তায় বসানো পোলের ক্ষেত্রে যুৎসই নয়। এটি আরসিসি হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। ভবিষ্যতে টেন্ডার ডকুমেন্টস প্রস্তুতির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীগণকে আরও বেশি সতর্ক ও বাস্তবিক হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলো। ডকুমেন্টস অনুযায়ী বৈদ্যুতিক পোলে ওয়েলডিং না করে একক পোল হওয়া উত্তম ছিল। এলইডি লাইটের মান টেস্ট রিপোর্ট অনুযায়ী সঠিক পাওয়া যায়। সার্বিক বিবেচনায়, সরবরাকৃত পোলের ক্যাবল এর গুণগতমান অত্যন্ত নিম্নমানের হওয়ায় ঠিকাদারের মাধ্যমে তা পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হলো। গুণগতমান সম্পন্ন ক্যাবল সাপ্লাই না দেওয়ায় ঠিকাদারের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ ইচ্ছে করলে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।’

ঠিকাদারের অনিয়ম সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারিত হয়। গত ২১ সেপ্টেম্বর চসিকের জনসংযোগ শাখা ‘ইন্ডিয়ান এলওসি এর মাধ্যমে বাস্তবায়িত এলইডি লাইটিং প্রকল্পের বিষয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত নিউজের ব্যাখ্যা প্রচার প্রসঙ্গে’ প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠায়। যেখানে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা প্রকল্পটির পরিচালক ঝুলন কুমার দাশ সাতটি বিষয়ে ব্যাখ্যা দেন। ৬ নং ব্যাখ্যায় চসিকের গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনকে ‘কথিত তদন্ত প্রতিবেদন’ উল্লেখ করে তথ্যগত ভুলসম্বলিত এবং প্রতিবেদনের গুণগত মান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন ওই প্রকৌশলী।

দেখা গেছে, তদন্ত হয়েছে ঠিকাদারের নিম্নমানের কাজ নিয়ে। অথচ ব্যাখ্যা দিয়েছেন প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ নিজে। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে ব্যাখ্যা দিয়েই ক্ষান্ত হননি তিনি, চসিকের জনসংযোগ শাখাকে এড়িয়ে অন্তত চারটি পত্রিকায় নিজের খরচে বিপুল টাকা ব্যয়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে এসব ব্যাখ্যাও প্রচার করছেন।

জানা গেছে, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার ব্যাপারে সিটি কর্পোরেশনের কোন অনুমোদনই নেননি প্রকৌশলী ঝুলন কুমার দাশ। সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা হয়ে তিনি স্বপ্রণোদিত হয়েও এভাবে বিজ্ঞাপন দিতে পারেন না। এটা আইনসিদ্ধও নয়। খোদ সিটি কর্পোরেশনের ভেতরেই গুঞ্জন চলছে— ঠিকাদারের নিম্নমানের কাজ নিয়ে তদন্ত হওয়ার পর সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশলী কেন আগবাড়িয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে চলেছেন?

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ২৬০ কোটি টাকার এলইডি প্রকল্পে অনুমোদিত ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) অনুসারে চারটি প্যাকেজে দরপত্র আহ্বান ও সম্পন্ন করতে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অথচ এক্ষেত্রে কোনো ধরনের প্রশাসনিক অনুমোদন ছাড়াই পুরো প্রকল্পকে একটি প্যাকেজে টেন্ডার করা হয়েছে। এ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন স্টিয়ারিং কমিটিতেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

এ ধরনের অনিয়ম নিয়ে চট্টগ্রাম প্রতিদিনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলেও প্রকল্প পরিচালক তার লিখিত ব্যাখ্যায় বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। একইসঙ্গে কালো তালিকাভুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এইচটিএমএসকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ, টেন্ডারে অংশ নেওয়া দুই প্রতিষ্ঠানের মালিক একই ব্যক্তি হওয়াসহ আরও নানা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন প্রকল্প পরিচালক। সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশলী ঝুলন দাশ অভিযুক্ত ওই প্রতিষ্ঠান এইচটিএমএস টেন্ডারে অংশ নেয়নি বলে দাবি করেও ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

জানা গেছে, ২৬০ কোটি টাকার এলইডি প্রকল্পের টেন্ডার মূল্যায়নকালে সংশ্লিষ্ট চারজন প্রকৌশলী নিশ্চিত করেছেন, অভিযুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এইচটিএমএসর নথি গায়েব করে এনার্জিপ্যাক ইলেকট্রনিক্স নামের আরেক প্রতিষ্ঠান হঠাৎ করে আবির্ভূত হয়। প্রকল্প পরিচালক ছাড়া মূল্যায়ন কমিটির অধিকাংশ সদস্য নিশ্চিত করেন,এনার্জিপ্যাক ইলেকট্রনিক্স নামের কোনো উপ-ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দরপত্রের নথিতেই ছিল না।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!