সুদের ১১ লাখ টাকা আত্মসাৎ করতেই স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে খুন ইপিজেডে

সুদের সাড়ে ১১ লাখ টাকা আত্মসাতের জন্যই স্বর্ণ ব্যবসায়ী সঞ্জয় ধরকে খুন করা হয়েছে। গত ২৪ জুন হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী বিকাশ কান্তি মল্লিক প্রকাশ তপন মল্লিককে (৫২) গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসে খুনের তথ্য। এরপর ১৭ জুলাই চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও সীতাকুণ্ড উপজেলা থেকে আরো দুজন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

তারা হলেন সিএনজি অটোরিকশা চালক শফিউল উমাম প্রকাশ বাদশা (৩৭)। তিনি চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড থানার ব্যারিস্টার কলেজ রোড মৌলভীর বাড়ির আবুল কালামের পুত্র। অপর আসামি হলেন পল্লী চিকিৎসক বিশ্বজিৎ। ওই গলিতে তিনি ফার্মেসির ব্যবসা করতেন।

গত ২১ জুন সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ইপিজেড থানার বন্দরটিলা আয়েশার মার গলির মনিশ্রী জুয়েলার্সের স্বত্ত্বাধিকারী সঞ্জয় ধরের (৪৫) লাশ তার দোকানের ভেতর থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। নিহতের বাড়ি কক্সবাজার জেলার রামু থানার বণিকপাড়ায়। সুধারাম মহাজনের পুত্র সঞ্জয় ধর ১২ বছর ধরে অস্থায়ী বাসা হিসেবে নগরীর বন্দরটিলায় ওই দোকানে থাকতেন।

রোববার (২০ জুলাই) দুপুরে নগরীর ইপিজেড থানায় আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সঞ্জয় ধর খুনের আগে ও পরের নানা তথ্য উপস্থাপন করেন সিএমপির উপ পুলিশ কমিশনার (বন্দর জোন) হামিদুল আলম।

জানা যায়, বিকাশ কান্তি মল্লিক প্রকাশ তপন মল্লিক একসময় নিহত সঞ্জয় ধরের স্বর্ণের কারিগর ছিলেন। বর্তমানে বন্দরটিলার আয়েশার মার গলিতে তপন মল্লিকের স্বর্ণের দুটি দোকান আছে। প্রায় সময় নিহত সঞ্জয় ধরের কাছ থেকে সুদে টাকা ধার নিতেন তপন। ধারের প্রায় ১০ লাখ টাকা নিয়ে থানা ও স্থানীয় কাউন্সিলরের কাছে সালিশ বৈঠকও হয়। এরপর টাকা নিয়ে গড়িমসি করায় সঞ্জয় ধর আদালতের মাধ্যমে চেক প্রতারণার একটি মামলা দেন তপনের বিরুদ্ধে। কিছুদিন এ মামলায় জেলও খাটেন তপন। জেল থেকে বের হয়ে এসেই তিনি খুনের পরিকল্পনা করেন।

সংবাদ সম্মেলনে ডিসি হামিদুল আলম বলেন, নিহত সঞ্জয় ধরকে খুনের মূল পরিকল্পনাকারী বিকাশ কান্তি মল্লিক প্রকাশ তপন মল্লিক হলে অপর দুজনও খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত। গত ২৩ জুন তপন মল্লিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনার পর থেকে এক মাস ধরে তদন্ত ও অভিযান চালিয়ে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত মো. শফিউল উমাম প্রকাশ বাদশা (৩৭) ও পল্লী চিকিৎসক বিশ্বজিৎকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে টাকা পেয়েছেন নিহত সঞ্জয় ধর। টাকা না দিতেই মূলত হত্যা পরিকল্পনা করেন। গত ২১ জুন রাত সাড়ে ১১টার দিকে মনশ্রী জুয়েলার্সে হত্যা করা হয়। ঘটনার একদিন পর মূল হোতা তপন মল্লিককে গ্রেফতার করে পুলিশ। ২৪ জুলাই চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে আরো দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়।

উপ পুলিশ কমিশনার আরও বলেন, এ ঘটনায় আর কেউ ইন্ধন আছে কিনা তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। খুনের সঙ্গে জড়িত বাকিদের গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত আছে বলে তিনি জানান।

যেভাবে পরিকল্পনা হয়
গ্রেপ্তারকৃত তিনজনের কাছ থেকে টাকা পেতেন সঞ্জয় ধর। বিভিন্ন সময় তার কাছ থেকে সুদের টাকা ধার নেন তারা। এর মধ্যে বিকাশ কান্তি মল্লিক প্রকাশ তপন মল্লিক ১০ লাখ, মো. শফিউল উমাম প্রকাশ বাদশা এক লাখ এবং পল্লী চিকিৎসক বিশ্বজিতের কাছ থেকে পেতেন ৫০ হাজার টাকা। তবে এক নম্বর আসামি বিকাশ কান্তি মল্লিক প্রকাশ তপন মল্লিকের কাছে পাওনা টাকা নিয়ে বেশ কয়েকবার ৩৯ নম্বর কাউন্সিলর অফিসে সালিশও হয়েছিল। এর আগে তপন মল্লিকের বিরুদ্ধে চেক প্রতারণার মামলাও করেন সঞ্জয় ধর। চেকের মামলায় তপন মল্লিক গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যান। জেল খেটে এসে ক্ষোভ জন্মায় সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে। সেই ক্ষোভ ও পাওনা টাকা পরিশোধ থেকে নিজেদের এড়াতেই মূলত সঞ্জয় ধরকে হত্যার পরিকল্পনা করেন তিনজন মিলে।

যেভাবে খুন হন সঞ্জয় ধর
২১ জুন সঞ্জয় ধর খুনের চারদিন আগে পরিকল্পনা করতে বৈঠক হয় তপন মল্লিকের মালিকানাধীন নিউ মল্লিক জুয়েলার্সে। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় শুক্রবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে তাকে হত্যা করে তাদের পাওনা টাকার ডকুমেন্ট নিয়ে আসা হবে। খুনের একদিন আগে সিএনজিচালক বাদশা ইপিজেড থেকে দুই টাকা দিয়ে একটি ছোরা কেনেন। রাত পৌনে এগারোটায় প্রথমে সঞ্জয় ধরের দোকানে ঢোকেন তপন মল্লিক। কিছু সময় পর ঢোকেন বাকি দুজন – বাদশা ও বিশ্বজিৎ। শুরুতে কথার ফাঁকে সঞ্জয় ধরের মুখ চেপে ধরেন তপন মল্লিক। আর এরপরই বাদশাসহ মিলে সঞ্জয়কে অজ্ঞান করার ইনজেকশন দেন চিকিৎসক বিশ্বজিৎ। সঞ্জয় অঞ্জান হয়ে গেলে বিশ্বজিৎ দোকান থেকে বের হয়ে যান। এরপর তপন তার বুকের ওপর উঠে ছুরি দিয়ে আঘাত করেন। এরপর পেটের দুই পাশে পর পর ছুরি চালিয়ে খুন নিশ্চিত হওয়ার পর তপনের কথামতো বেরিয়ে যান বাদশা। আরও প্রায় ২০ মিনিট সময় নিয়ে দোকানে থাকা তিনজনের ডকুমেন্ট ও সেখানে থাকা সিসি ক্যামেরা ভেঙ্গে ফেলে আলামতগুলো নিয়ে বেরিয়ে যান তপন মল্লিক।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন মহানগরের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (বন্দর জোন) আরেফিন জুয়েল, সহকারী কমিশনার (বন্দর) কামরুল হাসান, ইপিজেড থানার ওসি মীর নুরুল হুদা ও ওসি (তদন্ত ) ওসমান গনি, সেকেন্ড অফিসার (এসআই) নজরুলসহ খুনের তদন্ত টিমের কর্মকর্তারা।

আজাদ/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!