সুদীপ্ত হত্যা; ন্যায়বিচার নিয়ে পিতার শঙ্কা

চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সুদীপ্ত হত্যা মামলার দুই বছরেও কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে অভিযোগ করে তার বিচার নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তার বাবা স্কুল শিক্ষক মেঘনাথ বিশ্বাস বাবুল। যেই ফেসবুক পোস্ট নিয়ে সুদীপ্তকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল সেই ফেসবুকেই স্কুল শিক্ষক পিতা নিজের পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে আশংকা ও নির্দেশদাতা হিসেবে জবানবন্দিতে উঠে আসা লালখান বাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম মাসুমের জামিন পাওয়া নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপশি পুত্র হত্যার দুই বছরের মাথায় রেখেছেন নানা প্রশ্ন।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক মেঘনাথ বিশ্বাস শনিবার (৫ অক্টোবর) তার ফেসবুক পোস্টে ‘সন্তান হত্যার বিচার চেয়ে আমি আর আমার পরিবার আজ আমাদের জীবন নিয়ে শংকিত’ শিরোনামে স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, ‘আজ ৫ই অক্টোবর ২০১৭ সালের এই দিন শেষবারের মতো ছেলেটা আমাকে বাবা বলে ডেকেছিল। লক্ষ্মীপূজা ছিল। সকালে আমি বেরুচ্ছিলাম, এই সময় খুব সংকোচের সাথে বাবা ডেকে ছেলেটা আমার কাছে ২০টা টাকা চাইল। প্রায়ই চাইত। আমি ঝাঁঝিয়ে উঠলাম। আর কত দেবো তোকে? পকেটে ভাংতি ৩০ টা টাকা ছিল, তাই দিলাম। ছেলেটার মুখে সেই আমার শেষ বাবা ডাক শোনা। রাগ করি আর যাই করি, তার জন্য আমার হৃদয় উজাড় করা ভালবাসা ছিল। ছেলেটাও সেটা বুঝত, তারপর ৬ অক্টোবর আমার ছেলেকে হারানো মানে আমার সুখ-শান্তি, আশা-ভরসা, সর্বস্ব হারানোর দিন।’

সুদীপ্তের পিতা আরো লিখেন, ‘শুধুমাত্র প্রতিবাদের কারণে লালখান বাজারের এক বড় ভাইয়ের নির্দেশে একদল তারই পালিত হায়না লোহার রড, হকিস্টিক, চাপাতিসহ অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। মানুষ মানুষকে এভাবেও মারতে পারে। শরীরে এমন কোন জায়গা নাই যেখানে তাকে নির্মমভাবে আঘাত করা হয়নি। ডান হাতটা ভাঙ্গা ছিল। সে কারণে একটুও প্রতিরোধ করতে পারেনি। তার আর্তচিৎকারে বাতাস ভারী হয়েছিল কিন্তু কেউ তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। এখন কেউ এগিয়ে আসে না। মানুষকে এখন বড় ভয়।’

সুদীপ্ত হত্যার অভিযোগপত্র জমা না হওয়ার প্রসঙ্গে মেঘনাথ লিখেছেন, ‘মাননীয় যোগাযোগ মন্ত্রী জনাব ওবায়দুল কাদের সাহেব বিচারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু চার্জশিট এখনো দেওয়া হয়নি। কখন দেওয়া হবে বা আদৌ দেওয়া হবে কিনা জানি না। দেওয়া হলেও ন্যায়বিচার পাবো সে ভরসা কোথায়? বর্তমানে যে পরিস্থিতি মাকড়শার জালে বড় পোকা পড়লে জাল ছিড়ে বেরিয়ে যায়। আর ছোট পোকা জালে আটকা পড়ে মরে যায়। সুতরাং ন্যায়বিচার দেখে মরতে পারবো সেই আশাই গুড়ে বালি।’

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের ৬ অক্টোবর সকালে দক্ষিণ নালাপাড়ার বাসা থেকে ডেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় নগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাসকে। এ ঘটনায় সুদীপ্তর বাবা বাদি হয়ে সদরঘাট থানায় অজ্ঞাত সাত-আটজনকে আসামি করে একটি হত্যা মামলা করেন। হত্যাকাণ্ডের এক বছর পর বাদির আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত পিবিআইকে মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়। গত বছরের নভেম্বর মাসে পিবিআই মামলার তদন্ত কাজ শুরুর পর গত ১২ জুলাই মিজান নামে গ্রেপ্তারকৃত একজন তার জবানবন্দিতে দিদারুল আলম মাসুমের নাম উল্লেখ করেন। এরপর ৪ জুলাই ঢাকার বনানী থেকে মাসুমকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। ১৫ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়ে ছাড়া পান মাসুম।

মাসুমের জামিন পাওয়ার বিষয়ে ইঙ্গিত করে কারও নাম উল্লেখ না করে ফেইসবুক স্ট্যাটাসে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সুদীপ্তর বাবা মেঘনাথ।

তিনি লিখেছেন, ‘শুনেছি আরো কারো কারো বুক খালি করা সেই নির্দেশদাতা অসীম ক্ষমতার অধিকারী… লালখান বাজারের সেই মহান নেতা … মতের অমিল হলে খুন করা যার স্বভাব, যিনি কথায় কথায় গুলি চালান সেই বীরপুরুষ দুই মাসও জেল না খেটে বহাল তবিয়তে আবার নিজ সাম্রাজ্যে ফিরে এসেছেন। তারও আগে অন্যান্য খুনি আসামিরাও সবাই জামিন নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। এখন আমি আমার পরিবার নিয়ে খুবই ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।’

সুদীপ্তের বাবা আরও ফেসবুক স্ট্যাটাসে আরও লিখেছেন, ‘সকালে আমৃত্যু পুত্রশোক ধারণ করে ধুকে-ধুকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া আমার স্ত্রী নেতার বেরিয়ে আসার কথাটা শুনে হতাশায় দুঃখে বেদনায় কাঁদছিল। বললাম, কাঁদছ কেন? এক এক দেশে এক এক বাও, যে দেশে যে রীতি সেটাই তো হবে। লোকটা ক্ষমতাবান। ক্ষমতার বলয় এমন যে, সেখানে বিচারের বাণী পৌঁছতে পারে না। বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। নেতা বের হবেন- এটা আগেই জানতাম। দুঃখ পাওয়ার কিছু নাই। শুধু যন্ত্রণা হয় যখন ফেসবুকে হঠাৎ ভিডিওতে ধারণকৃত আমার ছেলেকে নির্মম পেটানো অবস্থায় মা মা আর্তনাদ আর কান্না আমার কানে অবিরাম অনুরণিত হয়ে আমাকে নিঃশেষ করে দিতে থাকে।’

এডি/এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!