সুজনের সঙ্গে ‘হট-টক’— ‘নির্বাচনের ফাঁদে পড়ে আমি হলাম প্রশাসক’

৬ মাসের ১ মাস শেষ

নির্ধারিত সময়ে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সম্পন্ন করতে না পারায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে (চসিক) প্রশাসক নিযুক্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। গত ৬ আগস্ট চসিক প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নেন নগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন। ৬ মাসের জন্য দায়িত্ব নেওয়া সুজনের এক মাস মেয়াদ শেষ হল রোববার (৬ সেপ্টেম্বর)।

এই এক মাসে বিভিন্নভাবে আলোচনায় ছিলেন সুজন। দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ‘জিহাদ’, ক্যারাভান কর্মসূচি, বিভিন্ন এলাকায় ঝটিকা পরিদর্শন, হাসপাতাল পরিদর্শন, চসিকে ব্যাপক রদবদলসহ নানা ঘটনায় আলোচনায় থাকা সুজনকে ঘিরে নগরবাসীও দেখছে পরিবর্তনের নতুন স্বপ্ন। অন্যদিকে কাজ করতে গিয়ে সুজন বারবারই বলে আসছেন চসিকের পরতে পরতে অনিয়ম আর দুর্নীতির কথা। বিশাল অংকের ঋণের বোঝার পাশাপাশি তীব্র অর্থ সংকটে ভোগা চসিকের হাল ধরা সুজনের এক মাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হলো চট্টগ্রাম প্রতিদিনের সঙ্গে।

চসিককে দুর্নীতির মস্তবড় এক অজগর সাপ বলেছেন। চসিকের কোথায় কী রকম দুর্নীতি হচ্ছে সে বিষয়ে কি একটু আভাস দেবেন?
খোরশেদ আলম সুজন :
শোনেন সবকিছুই একটা তদন্তের পর্যায়ে আছে। আমি সব কিছু তদন্ত করাচ্ছি। একটা প্রতিষ্ঠান এটা। আমি খুব কনফার্ম না হয়ে এখন আর কিছু বলবো না। তবে আপনারা একটু খুঁজেটুজে দেখেন— ধাক্কা কোথায় কোথায় লেগেছে। আমি তো একটা ধাক্কা দিছি।

সুজনের সঙ্গে ‘হট-টক’— ‘নির্বাচনের ফাঁদে পড়ে আমি হলাম প্রশাসক’ 1

এসব দুর্নীতির শ্বেতপত্র প্রকাশ করার কোনো পরিকল্পনা কি আছে?
সুজন :
শ্বেতপত্র প্রকাশ না, আমি সরকারকেই সবকিছু জানাবো।

আপনি একদিকে বলছেন চসিকের যেখানে হাত দিচ্ছেন সেখানেই অনিয়ম, আর্থিক সংকট কিংবা দেনায় জর্জরিত। অন্যদিকে আবার বললেন ‘মেয়র নাছির একজন ডায়নামিক মেয়র’— এর মধ্যে কোনটা আসলে আপনার মনের কথা?
সুজন :
দেখেন মানুষের ডায়নামিকজম বিভিন্ন ইয়েতে থাকে। বুঝছেন? আপনি একটু ঘুরে দেখেন, তার ভেতরেও ডায়নামিক কিছু ছিল। নয়তো আমাদের দল তাকে মেয়রও দিছে, আবার পার্টির সেক্রেটারিও দিছে না! মানুষ সবকিছুই মূল্যায়ন করবে— তবে সেটা এত তাড়াতাড়ি না। সে অনেকগুলো গাছের চারা লাগায়া গেছে। এখন সে চারাগুলাতে কী ধরনের ফল ধরে, কী ধরনের ফুল ফোটে সেগুলা দিয়েই মানুষ বিচার করবে তিনি আসলে ডায়নামিক ছিলেন কিনা।

সুজনের সঙ্গে ‘হট-টক’— ‘নির্বাচনের ফাঁদে পড়ে আমি হলাম প্রশাসক’ 2

চসিকে অনেক অপ্রয়োজনীয় খরচ হচ্ছিল— এরকম অভিযোগ তুলেছেন আপনি, সেটা কী রকম?
সুজন :
যেমন তেল বেশি খরচা হচ্ছিল। পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের মধ্যে কিছু বাড়তি খরচ হচ্ছিল। অনেকে কাজ না করে পয়সা নিছে। এরকম আরও অনেক খাত আছে। প্রত্যেক জায়গায় আমি কমিটি করে দিছি। এটার জন্য একটু অপেক্ষা করতে হবে। এটা একটু জটিল বিষয়। আমি খোঁজখবর করছি।

এসব অপ্রয়োজনীয় খরচ আপনি বন্ধ করতে পারছেন?
সুজন :
বন্ধ করতে না পারলেও এগুলোর উৎসগুলোর সন্ধান আমি পাইছি। এগুলো কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছি। এখানে অনেকে বিনা কাজে বেতন নিতো। তাদের চাইলেই আমি বের করতে পারছি না। সে যেহেতু নিয়োগপত্র পাইছে তাকে আমি বের করলেই সে সাথে সাথে কোর্টে দৌড় দেবে। সুতরাং এই জিনিসগুলো এত সহজ না। মানুষ ৫ বছর-১০ বছরে যেটা পারে না সেটা আমি একমাসে কিভাবে করবো? আমি কী করতে পারছি আর কী করতে পারছি না— সেটা চোখ মেলে আপনারা দেখেন।

বিপ্লব উদ্যান নিয়ে আসলে কী হচ্ছে? এটি বন্ধ করে দিলেন? অথচ চসিক তো অর্থসংকটেই আছে রীতিমতো…
সুজন :
বিপ্লব উদ্যানে ৫০ গন্ডা জায়গা আছে। এক গন্ডা জায়গার দাম দেড় কোটি টাকা। দেড় কোটি টাকার একটা পাবলিক প্লেস সেখানে বছরে ১ লাখ টাকায় ভাড়া দিছে। এখানে জনগণের কোটি টাকার স্বত্ত্বটা রক্ষা করার জন্য বছরে এক লক্ষ টাকার একটা ইয়ে বন্ধ করলাম। এগুলো আমি সরকারকে জানাইছি সব।

সুজনের সঙ্গে ‘হট-টক’— ‘নির্বাচনের ফাঁদে পড়ে আমি হলাম প্রশাসক’ 3

বন্দর কাস্টমসের কাছে অর্থ চেয়েছেন, সেখানে সাড়া মিলেছে? এটার কোনো রূপরেখা কি চূড়ান্ত করতে পারলেন?
সুজন :
অনেক ভাল আলোচনা হয়েছে সব জায়গায়। তবে এখনও আমি আনুষ্ঠানিক কোন প্রস্তাব দিই নাই। এটার জন্য একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন। এই বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলতে হবে। উনি যদি পারমিট করেন, তখন আমি আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেবো।

চসিকের স্বাস্থ্য খাতের গৌরব ম্লান হয়ে গেছে বলছিলেন। এটি কেন হয়েছে বলে মনে করেন— পরিচালনার অদক্ষতা নাকি পরিকল্পিতভাবে এটাকে নষ্ট করা হয়েছে?
সুজন :
এখানে কিছুটা অবহেলা ছিল, কিছুটা অমনোযোগিতা ছিল। মহিউদ্দিন চৌধুরীর আমলে স্বাস্থ্য খাত যেরকম সমৃদ্ধ ছিল, সেটা পরবর্তীতে বইসা গেছে। পরিকল্পিতভাবে এটাকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে কিনা এটা এখনও বলার সময় আসে নাই। তবে এটা ঠিক প্রচুর অবহেলা ছিল, প্রচুর উদাসীনতা ছিল।

তেল চুরি ধরার জন্য এক সপ্তাহ বাইরে থেকে তেল নেয়ার চুক্তি করেছিলেন। সেই চুক্তি নিয়ে আবার মৃদু বিতর্কও হয়েছে। তেল চুরির বিষয়টা কি শেষমেশ ধরতে পেরেছেন?
সুজন :
কিচ্ছু না… আমি এক সপ্তাহ… এখন সময় আসতেছে। এক মাস যখন হচ্ছে আমি এখন ফারাকটা বোঝার চেষ্টা করছি। আর বিতর্ক যারা করছে… আমাদের দেশে অপেশাদার কিছু লোক সাংবাদিকতায় ঢুকে পড়ছে। এদের না আছে একাডেমিক পড়াশোনা, না আছে পেশাদারিত্ব। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে কেউ ১০টা টাকার জিনিস বাকিতে দিতে চায় না। এক বছর প্যাচওয়ার্ক হয় নাই। কী জন্য হয় নাই? যারা ইট সাপ্লাই করে, যারা বৌল্ডার সাপ্লাই করে তারা সিটি কর্পোরেশনে ইট বৌল্ডার সাপ্লাই বন্ধ করে দিছে সিটি কর্পোরেশনের বকেয়া টাকার জন্য। আমি এসে এটা বুঝিয়ে-শুনিয়ে চালু করছি।

সুজনের সঙ্গে ‘হট-টক’— ‘নির্বাচনের ফাঁদে পড়ে আমি হলাম প্রশাসক’ 4

এখানে তেলটার জন্য আমি চাইছি আমার যে পাম্পটা— এটা ঠিক আছে কিনা। এটার যে ব্যবস্থা— মানুষকে তেল দেয়। দুই লিটার দিয়ে ৪ লিটার লিখে রাখে কিনা। এটা করার জন্য উনাকে (পেট্রোল পাম্পের মালিককে) আমি রিকোয়েস্ট করছি। কেউ দেয় নাই, উনি রাজি হইছে বাকিতে দেওয়ার জন্য। আর যেটা বলছে যে কি… ও আমার বিজনেস পার্টনার। এখন মানুষের মূর্খামি দেখলে তার জন্য আমার মায়া হয়, দয়া হয়। যার কোনো কাজ নাই, এখন ভালা কাম হইলেও এই লাইনে ঢুকি পরা। অধিকাংশ পত্রিকা কোনো বেতন দেয় না… পেডে ভাতে আর মাইনষেত্তুন গুতাই-গাঁতাইয়েরে যা পায়। আর দুর্নীতি যেটা ধরতে চেয়েছি নিশ্চয়ই সেটা ধরা পড়েছে। অপেক্ষা করেন না একটু! এটা তো সহজ জিনিস না। ১০ বছর কুড়ি বছর অনেকদিনের একটা…. এটা মহিউদ্দিন চৌধুরী আইসা তেল চুরি বন্ধ করার জন্য কর্পোরেশনের সব গাড়িগুলোকে সিএনজি করছিলেন। উনি যাওয়ার পর পর যারা চোর, তারা পরবর্তী মেয়রদেরকে উল্টা পাল্টা বুঝাইয়া… গ্যাস বিস্ফোরণ হবে, মানুষ মরে যাবে এসব বলে আবার তেলে আনছে। তেলে যাওয়ার পরে… যান না একটি টিসিতে যান না। চোরা তেল কিভাবে বিক্রি হয় দেখে আসেন, খবর নিয়ে আসেন। সব তথ্য আমার হাতে আছে।

সারাজীবন শ্রমিক ও হকারদের জন্য কথা বলেছেন। এখন মাঝে মাঝে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানেও যেতে দেখা যাচ্ছে। এই বিষয়ে কিছু বলুন…
সুজন :
আমি এখনও বলছি। সেটা হচ্ছে স্বউদ্যোগ কর্মসংস্থান। কিন্তু আমি আজকে একটা কথা বলেছি, মনে রাখবেন যে, তুমি আয় উপার্জন করার জন্য মানুষের পথের কাটা হবে না। মানুষের চলাচলকে বিঘ্নিত করে কাউকে পয়সা কামাতে দেওয়া হবে না। আমি যে নির্দেশনাটা দিছি ওটা যদি মাইনা চলে, ওরাও ব্যবসা করতে পারবে, আবার মানুষের চলাচলেরও কোন অসুবিধা হবে না। বলছি একটা ছোট হ্যাঙার বানাও, একটা ছোট বক্স নিয়া বস। সামনে জায়গা খালি রাখ। রাস্তাতে বসা যাবে না। বলছি তুমি রাস্তাতে বসতে পারবা না। ৩টা বাজে আসবা আর ৮টা বাজে বগল তলে করে নিয়ে বাড়িতে চলে যাবা। এরপর আমার লোক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে দেবে। যাতে পরেরদিন সকালে অফিসগামী মানুষ-কর্মমুখী মানুষকে যেন পথ চলাচলে কারও কাছে হোঁচট খেতে না হয়।

সুজনের সঙ্গে ‘হট-টক’— ‘নির্বাচনের ফাঁদে পড়ে আমি হলাম প্রশাসক’ 5

সামনে তো সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন হবেই। সেটা নিয়ে আপনার কী ভাবনা?
সুজন :
মেয়র ইলেকশনের একটা শিডিউল আছে। জানুয়ারিতে নির্বাচন হওয়ার কথা আছে। হলে অবশ্যই দল যেভাবে এটা দিছে, দলের প্রার্থীকে আমি সমর্থন করবো। আমি এখানে আসছি সামান্য সময়ের জন্য। নির্বাচনের ফাঁদে পড়ে আমি হলাম প্রশাসক। বুঝছেন? তো সুতরাং এই সংকটটা কেটে গেলে নির্বাচন হবে। যিনি নির্বাচিত হবেন উনি এসে চেয়ারে বসবেন।

মেয়র পদে এখন যিনি দলের প্রার্থী— রেজাউল করিম চৌধুরী, উনার সাথে আপনার একটা দূরত্বের কথা কেউ কেউ বলে…
সুজন :
এগুলো হইলো যাদের কাজ নাই তারা এই ধরনের কথা বলে। উনার সাথে কেন দূরত্ব থাকবে? উনি আর আমি ছোটবেলা থেকে এক সাথে রাজনীতি করছি। উনি আমার সিনিয়র। কিন্তু পার্টির উনি জয়েন্ট সেক্রেটারি, আমি ভাইস প্রেসিডেন্ট। তারপরে আবার ১৯৮২ সালে যখন পার্টি ভাগ হয়ে যায়, তখন আমি আর উনি একসাথে একই চিন্তায় কাজ করেছি। আবার পার্টি এক হওয়ার পর দুজনে একসাথে দলের মধ্যে এক হয়ে কাজ করতেছি। আমাদের মধ্যে সামান্যতমও কোন দূরত্ব নাই। আপনারা দেখেন নাই আমি উনার জন্য কিভাবে কাজ করেছি? আমার মধ্যে কোনো হীনমন্যতা নাই।

চসিকে আপনার আগে যিনি দায়িত্বে ছিলেন, সেই মেয়র আ জ ম নাছিরের সঙ্গে চট্টগ্রামের সিনিয়র অন্য নেতাদের সাথে সুসম্পর্ক ছিল না বলে অভিযোগ ছিল। তার জায়গায় বসে এই দূরত্বগুলো নিরসনে আপনি কী উদ্যোগ নিয়েছেন?
সুজন :
আমি সবাইকে নিয়েই চলতে চাচ্ছি। আমি যেদিন দায়িত্ব পেয়েছি তার পরেরদিন মহানগর আওয়ামী লীগের সাথে আমি সৌজন্য মিটিং করেছি। মোশাররফ ভাইদের সাথে দূরত্ব ছিল আমি উনাদের বাসায়ও গেছি। আমাদের দলের যারা আছে আমি সবাইকে নিয়েই চলতে চাই। আমি সবার হয়ে কাজ করতে চাই। কারো সাথে আমার দূরত্ব রাখা… যার সাথে শুধু আমার নীতির দূরত্ব আছে তার সাথেই শুধু আমি দূরে থাকবো।

৬ মাসের ১ মাস তো শেষ। এক মাস শেষে কি মনে হয়, পরিকল্পনা যা করেছেন তা কতোদূর করা সম্ভব হবে?
সুজন :
আমি তো আমার যে চেষ্টাগুলো করতেছিলাম, মানুষের অভাবনীয় সমর্থন আমাকে অভিভূত করেছে। আমি মনে করছি ইনশাআল্লাহ বাধা যত শক্তই হোক না কেন, আমি অতিক্রম করে চট্টগ্রামকে একটি বাসযোগ্য ও মানবিক শহর বানানোর আমার যে পরিকল্পনা সেটা বাস্তবায়ন করতে পারবো ইনশাআল্লাহ।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!