সীমা স্টিলের সীমাহীন ‘লুকোচুরি’, করোনা আক্রান্তের পরও লকডাউন নয়

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বানুরবাজারে সীমা স্টিল রি-রোলিং মিল লিমিটেডে (এসএআরএম) কর্মরত একজন শ্রমিকের করোনা শনাক্ত হয়। কিন্তু এরপরও সীমা স্টিল মিলের ওই কারখানা লকডাউন করা হয়নি। এতে আতংকে রয়েছে ওই কারখানার শত শত শ্রমিক। কারখানা লকডাউন না করে উল্টো শ্রমিকদের কর্মস্থলে আসতে বাধ্য করারও অভিযোগ উঠেছে।

শুধু তাই নয়, সনাক্ত হওয়া শ্রমিকের কর্মরতের দিনক্ষণ নিয়েও লুকোচুরি করছে সীমা স্টিল রি-রোলিং মিল লিমিটিড (এসএআরএম) কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।

এসএআরএমের একাধিক শ্রমিক অভিযোগ করেন, জানান, করোনা সনাক্ত ব্যক্তি কয়েকদিন আগেও কারখানায় কাজ করেছে। কারখানার সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখলেই এ বিষয়টি নিশ্চিত হবে প্রশাসন। কিন্তু প্রশাসনের লোকজন বিষয়টি নিয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। প্রশাসনের সঙ্গে সীমা স্টিলের মিল কর্তৃপক্ষের অনৈতিক সখ্যতা থাকায় শ্রমিক করোনা আক্রান্ত হওয়ার পরও কারখানা লকডাউন করছেনা।

রোববার (১০ মে) সীমা স্টিল রি-রোলিং মিলে কর্মরত এক শ্রমিকের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়। উপজেলা প্রশাসন সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাটের কলেজ রোড এলাকায় ওই শ্রমিকের বাসা লকডাউন করেছে। কিন্তু এসএআরএম এ তার সংস্পর্শে আসা শ্রমিকদের কাউকে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠায়নি প্রশাসন। কারখানাটি লকডাউনেরও কোন পদক্ষেপ গ্রহন করেনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্ত প্রতিটি রোগীর ক্ষেত্রে তার কর্মস্থল লকডাউন হওয়ার পাশাপাশি ব্যাংকে লেনদেন করার কারণে ব্যাংকও লকডাউন করার ঘটনা ঘটেছে।

নগরীর কাট্টলীতে এক গার্মেন্টস কর্মকর্তার শরীরে করোনা শনাক্ত হওয়ার পর তিনি ব্যাংক এশিয়ার আন্দরকিল্লা শাখায় লেনদেন করেছে বলে ওই শাখাটি লকডাউন করে সকল কর্মকর্তাকে হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠিয়েছিল।

সাতকানিয়ার কেরানীহাটেও আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসার সন্দেহ সৃষ্টি হওয়ায় এক ভবনে থাকা ছয়টি ব্যাংকের শাখা বন্ধ করে দেওয়া হয়।

এছাড়া একজন পুলিশ সদস্য আক্রান্ত হওয়ায় চট্টগ্রামে ২০০ সদস্যের গোটা পুলিশ ব্যারাক লকডাউন করা হয়।

স্থানীয়রা বলছেন, সীমা স্টিলের মত ইস্পাত শিল্প কারখানার শ্রমিক আক্রান্ত হওয়ার পরও প্রতিষ্ঠান লকডাউন না করার হলে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে এতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ শ্রমিকরা কারখানায় একজন আরেকজনের সঙ্গে থেকেই কাজ করে। সেখানে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলারও সুযোগ নেই।

এ প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনের এমন দায়সারা ভূমিকায় এলাকার মানুষ যেমন বিষ্মিত, তেমনি ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন অনেকে।

তারা বলছেন, লকডাউনের বিষয়টি কি একেক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে একেকরকম? প্রতিষ্ঠানভেদে কি মানুষ করোনা আক্রান্ত হচ্ছে? ব্যাংকের কর্মকর্তারা মানুষ, সীমা স্টিলের শ্রমিকরা কি মানুষ না? সীমা স্টিলের সঙ্গে উপজেলা প্রশাসনের বাড়তি কোন ‘খাতির’ আছে কিনা সে প্রশ্নও তুলেছে এ প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা।

এ বিষয়ে সীতাকুণ্ড উপজেলা করোনা বিস্তার রোধ ও প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি এবং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিল্টন রায় চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিধি মোতাবেক উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার পরামর্শে আমরা আক্রান্ত ব্যক্তির বাসস্থান লকডাউন করেছি।’

সীতাকুণ্ড উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. নুর উদ্দিন বলেন, ‘আক্রান্ত ব্যক্তি গত একসপ্তাহ বাসায় অবস্থান করেছেন। বাসায় থেকেই তিনি করোনা পরীক্ষার জন্য নমূনা দিয়েছেন। রিপোর্ট পজিটিভ আসায় আমরা তার বাসা লকডাউন করেছি। পরিবারের সদস্যদের শরীরের নমূনা সংগ্রহ করা হবে।’

তার কর্মস্থল লকডাউন বা ওখানকার কাউকে হোম কোয়ারেন্টাইনের বিষয় প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমরা এখনো তার কন্ট্রাক্ট ট্রেসিং করিনি। কন্ট্রাক্ট ট্রেসিংয়ের পর এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।’

সীমা স্টিল রি-রোলিং মিলস লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক কামাল উদ্দিন বলেন, ‘করোনা যেহেতু ছোঁয়াছে রোগ আমরা কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবো। প্রশাসনিক পদক্ষেপ ছাড়াও আমাদের অন্যান্য স্টাফদের নিরাপদ ও সুস্থ থাকার বিষয়টিও আছে। আক্রান্ত স্টাফ ছুটিতে যাওয়ার আগে কার কার সংস্পর্শে এসেছে, তাদের কী অবস্থা সব বিষয় আমরা খবর নিচ্ছি। আপনারা শিগগিরই জানতে পারবেন।’

এর আগে ৬ মে কুমিরা এলাকার পিএইচপির একটি কারখানায় একজন কর্মীর শরীরে করোনা শনাক্ত হয়েছিল। ওই ঘটনা রাতেই প্রশাসন কারখানাটি লকডাউন করলেও পরদিন মাত্র একঘন্টা বন্ধ রাখার পর লকডাউন ভেঙে প্রায় দুই হাজার শ্রমিককে কাজে যোগদান করানো হয়।

পিএইচপি এবং সীমা স্টীলের ক্ষেত্রে এমন ছাড়ে সীতাকুণ্ডের মানুষ হতবাক। সীতাকুণ্ডের বাসিন্দা সোহরাব হোসেন বলেন, ‘পুঁজিপতিদের লাভ করে দিতে প্রশাসনের এমন ছাড় পুরো সীতাকুণ্ডবাসীকে হুমকির মুখে ফেলে দিবে। প্রশাসনের উচিত করোনা বিস্তার রোধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।’

চলতি বছর ১৪ জানুয়ারি সীমা স্টিল রি-রোলিং মিলে বিস্ফোরণের ঘটনায় ৫ শ্রমিক গুরুতরভাবে দগ্ধ হয়। মিলে ফার্নেস অয়েলে লোহা গলানোর কাজ করার সময় বিস্ফোরণে তারা আহত হন বলে জানা গেছে।

এর আগে ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই বিস্ফোরণে ৯ শ্রমিক দগ্ধ হয়। মাত্রাবহির্ভূত অপরিশোধিত বিষাক্ত বায়ু ছেড়ে দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ দূষণ করে গত বছর ৯ ডিসেম্বর ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও গুণতে হয়েছে প্রতিষ্ঠানটিকে।

জানা যায়, সীমা স্টিল ১৯৯১ সাল থেকে জাহাজ ভাঙা দিয়ে শুরু করে কোম্পানির ব্যবসা। ২০০৩ সাল থেকে ইস্পাত পণ্য রড উৎপাদনে যুক্ত হয় সীমা অটোমেটিক রি-রোলিং মিলস। কোম্পানিটির বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৬০ হাজার মেট্রিক টন।

এফএম/এমএফও

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!