‘সিনহা খুনে অসৎ উদ্দেশ্য’— ৮০ পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্টের সঙ্গে ২১ পৃষ্ঠা ছবি

এফবিআইয়ের আদলে সংস্থা গঠনের সুপারিশ

অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা হত্যার পেছনে রয়েছে ‘অসৎ উদ্দেশ্য’— এমন সিদ্ধান্তে এসেছে মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যার ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত কমিটি। এই কমিটির দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত ‘শুধু কৃতিত্ব’ পেতে গুলির ঘটনা ঘটিয়েছেন। অন্যদিকে কক্সবাজারের এসপির ভূমিকা ছিল বিতর্কিত। প্রতিবেদনে এসেছে টেকনাফ থানার বহিস্কৃত ওসি প্রদীপের প্রসঙ্গও। এমনকি তার ব্যক্তিগত দুটি অস্ত্রের কথাও এসেছে। প্রচলিত পুলিশের বাইরেও যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই-এর মতো স্বাধীন একটি তদন্ত সংস্থা থাকতে পারে বলে কমিটি মতপ্রকাশ করেছে— যেখানে চাইলে ভুক্তভোগীরা যেতে পারবেন। চেকপোস্টে সিসিটিভি ও ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয়েও গুরুত্বারোপ করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত এই কমিটি।

সোমবার (৭ সেপ্টেম্বর) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছে এ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। ৮০ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদনে সুপারিশ রয়েছে ১৩টি। সঙ্গে রয়েছে ২১ পৃষ্ঠার ছবির অ্যালবাম। এছাড়া সংযুক্তি আছে ৫৮৬ পৃষ্ঠার। তদন্ত কমিটি ৬৮ জনের বক্তব্য রেকর্ড করেছে।

গত ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের শামলাপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ। ঘটনার তিন দিন পর চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান এবং অতিরিক্ত ডিআইজি জাকির হোসেন খান, লে. কর্নেল এসএম সাজ্জাদ হোসেন ও কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ শাহজাহান আলীকে সদস্য করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তিন দফায় সময় বাড়িয়ে ৩১ দিন পর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিল এই কমিটি।

তদন্ত প্রতিবেদনে কী আছে— এ নিয়ে সরাসরি কোনো বক্তব্য পাওয়া না গেলেও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে জানা গেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে—

লিয়াকতের ‘হঠকারী’ সিদ্ধান্ত
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, আইনি ভিত্তি ছাড়াই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত না করে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত ‘শুধু কৃতিত্ব’ পেতে গুলির ঘটনা ঘটিয়েছেন। তার গুলি করার সিদ্ধান্ত ছিল ‘হঠকারী’। ‘ডাকাত আসার তথ্য’ ঠিকভাবে যাচাই না করেই অভিযান শুরু করা হয়। অভিযান শুরুর আগে অতিরিক্ত ফোর্সও নেওয়া হয়নি।

কক্সবাজার পুলিশের দায়িত্বহীনতা
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ঘটনার পর কক্সবাজারের পুলিশ বিষয়টির সংবেদনশীলতা, তদারক ও মাঠ পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারেনি। সিনহা হত্যার ঘটনায় কক্সবাজারের পুলিশ প্রশাসন দায়িত্বশীল পর্যায় থেকে সঠিকভাবে বিষয়টি তদারক করতে পারেনি বলে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের জবাবদিহি যথাযথভাবে নিশ্চিত করতে পারেননি সেখানকার পুলিশ সুপার (এসপি)।

একজনের তিন পরিচয়
ডাকাতসন্দেহে যেসব গ্রামবাসী পরিদর্শক লিয়াকতকে তথ্য দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে একজনের তিন ধরনের পরিচয় পাওয়া গেছে। লিয়াকত বলেছিলেন, ওই ব্যক্তি কমিউনিটি পুলিশের সভাপতি। ওসি প্রদীপ বলেছিলেন, সহ-সভাপতি। আরেকজন বলেছেন, কমিউনিটি পুলিশের সদস্য।

প্রদীপের ব্যক্তিগত দুই অস্ত্র
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে পাহাড়ে গিয়ে সিনহার ভিডিওচিত্র তৈরির বিষয়টিও এসেছে। এর সঙ্গে মূল ঘটনার কী ধরনের যোগসূত্র রয়েছে— সে তথ্য তুলে ধরা হয় প্রতিবেদনে। এতে ওসি প্রদীপ কুমার দাশের দুটি ব্যক্তিগত অস্ত্র থাকার কথাও তুলে ধরা হয়েছে।

ক্রাইম সিনে আরও মনোযোগ
কমিটির প্রতিবেদনে চেকপোস্টে সিসিটিভি ও ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের বিষয় যেমন এসেছে, তেমনি ক্রাইম সিন সংরক্ষণে আরও মনোযোগী হতে পুলিশকে নির্দেশনা দেওয়ার বিষয়টি প্রতিবেদনে এসেছে। গুলিবর্ষণের ঘটনায় নির্বাহী তদন্তের সময় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভূমিকাও তীক্ষ্ণ নজরদারির মধ্যে রাখার কথা বলা হয়েছে এতে।

এফবিআইয়ের আদলে তদন্ত সংস্থা
প্রতিবেদনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত সংস্থা এফবিআই-এর আদলে একটি পৃথক তদন্ত সংস্থা গঠন করার কথা বলা হয়। প্রচলিত পুলিশের বাইরেও এফবিআই-এর মতো স্বাধীন একটি তদন্ত সংস্থা থাকতে পারে বলে কমিটি মতপ্রকাশ করেছে। যেখানে চাইলে ভুক্তভোগীরা যেতে পারবেন। এ ধরনের তদন্ত সংস্থা হলে অন্যান্য তদন্ত সংস্থার মধ্যে আরও ভালো কাজ করার মনোবৃত্তি গড়ে উঠবে বলে কমিটির তিন সদস্য একমত হয়েছেন। তবে যৌথ তদন্ত দল গঠনের ব্যাপারে কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত পুলিশ সদস্য নোট অব ডিসেন্ট বা অসম্মতি জানিয়েছেন।

টেকনাফ কেন গুরুত্বপূর্ণ
কেন এবং কী কারণে কক্সবাজার ও টেকনাফ বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকা— সে বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করে প্রতিবেদনে সমাজ থেকে মাদক নির্মূলে একটি সমন্বিত পরিকল্পনার কথাও বলা হয়েছে।

ঘটনার উৎস, কারণ ও সুপারিশ প্রণয়ন
তদন্ত কমিটির প্রধান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘এক মাসের বেশি সময় তদন্ত করে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। গত ৩ তারিখ থেকে কী কী করা হয়েছে, তার সবকিছু বিস্তারিত সংযুক্ত আছে। তদন্তের কাজে কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থলগুলোতে রাত ৯টার দিকেও গেছেন। রাতে এপিবিএনের ফোর্স নিয়ে ডেমো করা হয়েছে, বোঝার চেষ্টা করেছি। যে পাহাড়ে মেজর সিনহা গেছেন, সেই পাহাড়েও গিয়েছি। ওখানকার লোকজনের সঙ্গে কথা হয়েছে। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্নেষণ করে উৎস, কারণ ও সুপারিশ প্রণয়ন করা হয়েছে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!