সিনহার বুকে প্রদীপেরও দুই গুলি, লিয়াকতের ৪— প্রত্যক্ষদর্শীর মর্মন্তুদ বয়ান

‘নোহা নিয়া প্রদীপ স্যার আসছেন। প্রদীপ দাশ আসার পরে যখন ওই লোকটা (সিনহা) দরফড়াইতেছে (যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে)। তখন আইয়া একটা পাড়া (পা) দিসে সিনার ওপর। কুত্তার বাচ্চা বলে পাড়া দিয়ে দাড়াম দাড়াম দুইডা করছে ফায়ার, আমার সামনে।’ এমনই কথা উঠে আসলো বেসরকারি একটি টিভি চ্যানেলকে দেওয়া এক প্রত্যক্ষদর্শীর ভিডিও সাক্ষাৎকারে।

কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সড়কে পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহতের ঘটনার তদন্তে তদন্তকারী দল এবং গণমাধ্যম কর্মীরা নতুন নতুন তথ্য পাচ্ছেন। সর্বশেষ রোববার (৮ আগস্ট) সকালে এই তথ্য উঠে আসলো।

ওই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে চার রাউন্ড গুলি করেন টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (আইসি) ইন্সপেক্টর লিয়াকত আলী। ওই সময় গুরুতর আহত অবস্থায় পড়ে থাকার পর খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস। ওসি নিজেই চালান আরও দুই রাউন্ড গুলি। এর পরপরই নিস্তেজ হয়ে যায় মেজর সিনহার নিথর দেহ— জানিয়েছেন শামলাপুর পুলিশ ফাঁড়ির সামনে ওইদিন পুলিশের বর্বর হত্যাকান্ডের দৃশ্য সরাসরি প্রত্যক্ষ করা ওই যুবক।

ওই যুবক আরও জানান, ‘সিনহা (সিনহা মো. রাশেদ) স্যার গাড়িটি নিয়ে আসার পরে হাত উঁচিয়ে সিঙ্গেল (সিগনাল) দিছে। গাড়িটি সাইড করায় রিভলবার নিয়ে হ্যান্ডসাফ (হ্যান্ডসআপ) দিছে। এরপর উনি (সিনহা) বের হয়ে একটা পা বাইর করছে। এইভাবে হাত উঠাইছে (হাত উপরে তোলা)। কোনো কথা কোনো কিছু না বলে দাড়াম দাড়াম তিনডা ফায়ার করছে (সরাসরি তিনটা গুলি করে)। ফায়ার করার পরে গাড়ির ভেতরে চুল লম্বা করে একটি ব্যক্তি ছিল, হ্যাংলা (হালকা) ফর্সা করে। ওই ব্যক্তিটা বাইরঅইয়ে (বের হয়ে) সিনহা স্যারকে এইভাবে ধরছে (দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছে)। ধরার পর ওরা দুইজন এসেই দুই সিপ্টে ধইরা ওয়ালের পাশে নিছে (দুই পুলিশ সদস্য ধরে সিনহাকে পাশে ওয়ালের পাশে নিয়ে যায়)। এরে দিছে দুইটা গুলি (তাকে গুলি দেওয়া হয়)। এরপর লিয়াকত মোবাইলে কথা বলে এক দৌড়ে এইদিকে হাঁটি হাঁটি এইদিকে আসে, আরেক দৌড়ে ওইদিকে যায়। যাওয়ার পর বলে যে স্যার তিন রাউন্ড গুলি করছি, তো অকন কই? দুই মিনিট হইছে না (দুইমিনিট পার না হতেই) সা করে (তাৎক্ষণিক) নোহা নিয়ে চলে আসেন প্রদীপ স্যার। প্রদীপ দাশ আসার পরে যখন ওই লোক (সিনহা) দরফড়াইতেছে (যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে)। তখন আইয়া একটা পাড়া (পা) দিসে সিনার ওপর। কুত্তার বাচ্চা বলে পাড়া দিয়ে আমার চোখের সামনে দাড়াম দাড়াম দুইডা ফায়ার করছে।’

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ওই যুবক আরও জানায়, ‘কিছুক্ষণ পর ইন্ডিয়ান চারপোকা একটি গাড়ি আসে। চারপোকাতে এসেই এইভাবে (দুই পাশ থেকে ধরে) ধাক্কা দিয়া উঠায় দিছে।’

এর আগে লিয়াকতের করা চার রাউন্ড গুলির বিষয়টি নিশ্চিত হলেও লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনে উঠে আসে ছয়টি গুলির কথা। এরপর থেকেই প্রশ্ন ছিল বাড়তি দুটি গুলি কে করেছিল? প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় জবাব মিললেও তদন্ত কর্মকর্তাদের কেউ এখনই মুখ খুলতে চাচ্ছেন না।

গত ৩১ জুলাই রাত সাড়ে ১০টার দিকে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়ায় মেরিন ড্রাইভ সড়কে চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে সদ্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহত হয়েছেন। গত ২ আগস্ট চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মো. মিজানুর রহমানকে আহবায়ক করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

এর আগে ৫ আগস্ট দুপুরে পুলিশের গুলিতে সিনহার মৃত্যুর ঘটনাকে একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড উল্লেখ করে টেকনাফের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন মেজর সিনহার বড়বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস। পরে আদালতে মামলাটি আমলে নিয়ে ওইদিন রাত সাড়ে ১০ টার দিকে টেকনাফ থানায় হত্যা মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করা হয়। মামলায় আসামি করা হয় টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাস, বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (আইসি) লিয়াকত আলী, এসআই নন্দলাল রক্ষিত, এসআই টুটুল, এএসআই লিটন মিয়া, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কনস্টেবল কামাল হোসেন, কনস্টেবল আবদুল্লাহ আল মামুন ও কনস্টেবল মো. মোস্তাফাকে।

মুআ/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!