সিঙ্গেল ডিজিটে সুদের হার শুধু কথার কথা!

সিঙ্গেল ডিজিটে সুদের হার নামিয়ে আনার ঘোষণা কার্যকর করেনি ব্যাংকগুলো। সরকারি দু একটি ব্যাংক এটি কার্যকর করলেও অধিকাংশ ব্যাংকেই সুদের হার রয়েছে ডাবল ডিজিটে। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার সুদের হার কমানোর নির্দেশনা দিয়েছেন এবং এখনো পর্যন্ত এক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি না হওয়ায় তার অসন্তোষও রয়েছে। সুদের হার কমানোর জন্য ব্যাংকগুলোকে বেশকিছু সুবিধাও ভোগ করছে। সরকারি তহবিল প্রাপ্তির শর্ত হিসাবেও সিঙ্গেল ডিজিটে সুদ হারের শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও এ ব্যাপারে দৃশ্যমান তৎপরতা কম বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট মহল। এ কারণে সিঙ্গেল ডিজিটে সুদের হার এখন কথার কথায় পরিণত হয়েছে।

জানা গেছে, ব্যাংক সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিট গত ১ জুলাই ২০১৮ থেকে কার্যকর করার কথা। ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবি’র কাছ থেকে সব ঋণের ক্ষেত্রেই সুদের হার সিঙ্গেল ডিজিটে করতে হবে— এমন ঘোষণাই এসেছিল । এ নিয়ে একাধিক বৈঠকও হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, বাস্তবায়ন না করলে ব্যবস্থা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বলেছে, যারা সুদ কমাবে না, তাদের কর্পোরেট ট্যাক্স কমানো হবে না। কিন্তু ব্যাংকগুলো কারো কথার তোয়াক্কা করছে না। বরং ব্যাংকগুলো তাদের পরিচালন মুনাফার উল্লম্ফন দেখিয়ে শেয়ারবাজারে প্রভাব ফেলতে তৎপর। বেশি সুদ, মুদ্রাবাজার ও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের মাধ্যমে মুনাফার পথে হাঁটলেও শিল্পে পুঁজি যুগিয়ে কর্মসংস্থানমুখী প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিকে ব্যাংকগুলোর নজর ছিল কম।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৬ শতাংশ হারে টাকা পেলেও, বেসরকারি ব্যাংকগুলো জনগণের কাছ থেকে (বেসরকারি খাত থেকে) এ হারে ডিপোজিট পাচ্ছে না। তাই ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশ হারে লোন দিতে পারছে না। গ্রাহকদের কম লাভ দিলে ব্যাংকে কেউ টাকা রাখবেও না। তাই গ্রাহকদের একটি ন্যায্যহারে লাভ দিতে হচ্ছে।

চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক এসএম আবু তৈয়ব বলেন, ব্যাংক সুদ এত টাকা পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই। বেসরকারি ব্যাংকগুলো সুদের হার এখনো না কমানোতে আমরা অনেক টাকা ক্ষতিতে পড়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংকের আরো কঠোর তদারকি দরকার।

ঢাকা ব্যাংকের সাবেক প্রিন্সিপাল অফিসার মোহাম্মদ আলী বলেন, সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে অনেক সময় ১১ থেকে ১২ শতাংশ হারে লাভ দিতে হচ্ছে গ্রাহকদের। বিভিন্ন স্কিমে গ্রাহকদের পর্যাপ্ত লাভ না দিলে কেউ ব্যাংকে টাকা রাখতে চাইবে না। ফলে সিঙ্গেল ডিজিট বাস্তবায়ন খুবই অসম্ভব। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ৯ শতাংশ লাভ দেওয়া হচ্ছে গ্রাহকদের।

এদিকে সুদ ও দণ্ড সুদের কারণে এদেশে নতুন উদ্যোক্তার বিকাশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। উদ্যোক্তারা বলছেন, বিশ্বের কোথাও এতবেশি হারে ব্যাংক ঋণের সুদ নেওয়া হয় না। এমনকি সুদের ওপর সুদ আরোপের মাধ্যমে শিল্পকে রুগ্ন করে দেওয়ার নজিরও বিশ্বে নেই। একজন উদ্যোক্তা নানা সমস্যায় ভোগেন। গ্যাস বিদ্যুৎ সংকটের কারণে উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হলে বাণিজ্যে বিরূপ প্রভাব পড়ে। ফলে, ব্যাংক ঋণের কিস্তি খেলাপি হলেই উদ্যোক্তার ওপর দণ্ডসুদের খড়গ নামে।

ব্যাংকগুলোর নিজস্ব তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, শিল্প ঋণে মূলধনী ও মেয়াদি উভয় ঋণের ক্ষেত্রে অধিকাংশ ব্যাংকই সিঙ্গেল ডিজিটে সুদের হার নামিয়ে আনার নিয়ম মানছে না। এসব ব্যাংক মাঝারি ও বড় শিল্পের জন্য কিছুটা কম সুদ নিলেও ছোট শিল্পের জন্য অনেক বেশি সুদ নিচ্ছে। ফলে ছোট শিল্পগুলোর জন্য ব্যবসা পরিচালনা করা কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে। আর নতুন বেশি সুদ পরিশোধ করে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠা করাও সম্ভব হচ্ছে না।

অন্যদিকে, সরকার ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকে উৎসাহ দিতে বদ্ধপরিকর। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) প্রতিষ্ঠান উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা টেকসই হতে পারে না। সাম্প্রতিক সময়ে দেখা গেছে এসএমই খাতে সুদের হার বরং বেশি। অথচ এখাতে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে।

অর্থনীতিবিদ প্রফেসর সেকান্দর খান বলেন, সরল সুদ ও সিঙ্গেল ডিজিট সুদ হার বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। কিন্তু ব্যাংকগুলো সেটি বাস্তবায়নে হিমসিম খাচ্ছে। সবাই তো সবার লাভ বোঝে। ব্যাংক গুলো লাভবান হতে চায়। কিন্তু মানুষকে দিতে চান না। সিঙ্গেল ডিজিটে লোন না দিলে শিল্প উদ্যোক্তার বিকাশ ঘটবে না।

বাংলাদেশের একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে টাকা ফেরত দেওয়ার প্রবণতা নেই আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের। খেলাপীর কারণে অনেক ব্যাংক দেউলিয়া। ব্যাংকের সুদ কমবে কি বাড়বে সেটি অর্থনীতির ওপর নির্ভর করে। অর্থনীতির বাজার থেকে ঋণের সুদের হারটার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হবে। সরকার জোড় করে চাপিয়ে দিলে চলবে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এখনো বেশিরভাগ ব্যাংকের ঋণের সুদহার দুই অঙ্কে রয়েছে। এবি ব্যাংক বাণিজ্যিক ঋণে সুদ নিয়েছে ৯ থেকে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত। ব্র্যাক ব্যাংক শিল্পঋণে ১১ থেকে ১৪ শতাংশ, ঢাকা ব্যাংক ৯ থেকে ১২ শতাংশ, ডাচ্-বাংলা ৯ থেকে ১২ শতাংশ, ইস্টার্ন ব্যাংক ৯ থেকে ১২ শতাংশ, আইসিবি ইসলামিক ১৫ থেকে সাড়ে ১৬ শতাংশ, যমুনা ব্যাংক সাড়ে ১৩ শতাংশ, মিডল্যান্ড ব্যাংক ১১ থেকে ১৪ শতাংশ সুদ নিয়েছে। মার্কেন্টাইল ব্যাংক বাণিজ্যিক ঋণে সাড়ে ১০ থেকে সাড়ে ১৩ শতাংশ, মেঘনা ব্যাংক ১২ থেকে ১৫ শতাংশ, মধুমতি ব্যাংক সাড়ে ১১ থেকে সাড়ে ১৪ শতাংশ, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক ৯ থেকে ১২ শতাংশ, ন্যাশনাল ব্যাংক ১২ থেকে ১৫ শতাংশ, এনসিসি ব্যাংক সাড়ে ১০ থেকে সাড়ে ১১ শতাংশ, এনআরবি ব্যাংক ১১ থেকে ১৪ শতাংশ, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক সাড়ে ১১ থেকে সাড়ে ১৪ শতাংশ, ওয়ান ব্যাংক সাড়ে ১২ থেকে সাড়ে ১৫ শতাংশ, প্রাইম ব্যাংক ৯ থেকে ১২ শতাংশ, পূবালী ব্যাংক সাড়ে ১৩ থেকে ১৪ শতাংশ, সাউথ-বাংলা এগ্রিকালচারাল ব্যাংক বাণিজ্যিক ঋণে ১২ থেকে ১৪ শতাংশ, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক বাণিজ্যিক ঋণে ৯ থেকে ১২ শতাংশ, সিটি ব্যাংক ১২ দশমিক ২৫ থেকে সাড়ে ১৪ শতাংশ, ট্রাস্ট ব্যাংক সাড়ে ১০ থেকে সাড়ে ১৩ শতাংশ ও উত্তরা ব্যাংক বাণিজ্যিক ঋণে ১১ থেকে ১৪ শতাংশ সুদ নিয়েছে। বিদেশি ৯ ব্যাংকও শিল্প ও বাণিজ্যের কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুই অঙ্কের সুদ নিয়েছে।

সিআর

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!