সাফল্যের গল্প শোনালেন জয়িতা নারীরা

কক্সবাজারের ইয়াছমিন আর নোয়াখালীর সুমী— পথের দূরত্ব অনেক হলেও জীবন সংগ্রামের গল্প একই। চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর এলজিইডি ভবন ভরে উঠেছিল এমনই অনেক ইয়াছমিন ও সুমীর জীবনের গল্পে। হলভর্তি দর্শকের পিনপতন নীরবতা ছিলো। অতিথিসহ অনেকের চোখেই জল গড়িয়ে পড়ছিল।

চট্টগ্রাম নগরীর ষোলশহরের এলজিইডি ভবনে বুধবার (১৩ নভেম্বর) সকাল ১১টায় স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অবদানের জন্য নারীদের সম্মাননা প্রদানে ‘জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ— ২০১৮’ অনুষ্ঠিত হয়।

অনুষ্ঠানের শুরুতে হলভর্তি দর্শকদের জয়িতা নারীরা তাদের সংগ্রামের গল্প শোনান। প্রতিবন্ধী জীবনের সফলতার গল্প শোনান।

এ অনুষ্ঠানে ১১ জেলার ৫৪ জন জয়িতা ও ৫ জন শ্রেষ্ঠ জয়িতাকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। সম্মাননার জন্য মনোনীত পাঁচজন হলেন অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী কক্সবাজারের ইয়াছমিন আক্তার, শিক্ষা ও চাকরির ক্ষেত্রে ডা. সুপর্ণা দে সিম্পু, সফল জননী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সপনেহার বেগম, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করার ক্ষেত্রে রত্না চক্রবর্তী, সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখায় বান্দবানের পাইম্রাং মার্মা।

নোয়াখালীর সুমী আক্তারের জন্ম হয়েছিল অভাবের সংসারে। জন্মের পর দেখা যায় তার দুটি হাত বিকল। একদিকে প্রতিবন্ধী, তার ওপর কন্যাসন্তানের জন্ম খুব একটা উৎসবের ছিল না। বরং সুমীর মাকে সমাজের বিভিন্ন মানুষেরা পরামর্শ দেয় তাকে যেন লবণ খাইয়ে মেরে ফেলা হয়! এ তীর্যক দৃষ্টি শৈশবেই বুঝে নেন সুমী। মানুষের কটুক্তি থেকে বাঁচতে নিজের হাত দুটো ওড়নায় ঢেকে রাখতেন। বাল্যকাল থেকে মেধাবী সুমী গরিব মা-বাবার সহযোগিতা ও তার অদম্য ইচ্ছায় পড়ালেখা চালিয়ে যান। ২০১১ সালে সুমী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। অভাব ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে ২০১৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি বিভাগে অনার্স ও পরে মাস্টার্স পাশ করেন। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম নগরের বায়েজিদ থানার কুলগাঁও স্কুল অ্যান্ড কলেজে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। সামনে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি ভবিষ্যতে দেশের সেবা করতে চান।

তুলিয়াপালং গ্রামের ইয়াছমিন আক্তার বাবার তৃতীয় স্ত্রীর সন্তান হওয়ায় অঢেল সম্পত্তির কোন অংশ পাননি। ১৭ বছর বয়সে বিয়ে হওয়ার পর স্বামীর সংসারেও অভাব। সংসারের প্রয়োজন মেটাতে এনজিও থেকে ৬০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে গরু পালন শুরু করেন। একসময় গরুর সংখ্যা বেড়ে আঠারোয় দাঁড়ায়। দৈনিক ৬০ কেজি দুধ বিক্রি করে সংসারের অভাব দূর করেন। নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে সমাজের অবহেলিত ও পিছিয়েপড়া নারীদের নিয়ে কাজ শুরু করেন। নিজের প্রবল ইচ্ছায় পৌরসভা কাউন্সিলর নির্বাচন করে প্রথমবার হেরে যান। সবার নিষেধ উপেক্ষা করে পরেরবার কাউন্সিলর নির্বাচনে জয় পান। এখন তিনি নারীর ক্ষমতায়নে কাজ করে যাচ্ছেন।

এতে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেছা ইন্দিরা বলেন, ‘আদিকাল থেকে নারীরা নির্যাতিত। নারীদের বাদ দিয়ে কোন উন্নয়ন সম্ভব নয়। ১৯৭২ সালে সংবিধানে নারী পুরুষের সমান অধিকার দেওয়া হয়। ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জয়িতা চালু করেন। বর্তমানে তা দেশের জেলা উপজেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। ভবিষ্যতে জয়িতার কার্যক্রম আরো বাড়বে। প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করে অদম্য চেষ্টায় নিজেকে এগিয়ে নিতে হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ প্রথম ও সরকারে শীর্ষ পর্যায়েও নারীর ক্ষমতায়ন বিশ্বে বিরল। নারীদের নিজেদের অধিকার অর্জনে কাজ করে যেতে হবে। অধিকার কেউ দেয় না অর্জন করে নিতে হয়। প্রত্যেক সংগ্রামী নারী একজন জয়িতা।’

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুন নাহার বলেন, ‘প্রত্যেক নারীর উঠে আসার পেছনে একটি গল্প রয়েছে। অনেকের সংগ্রামের গল্প ভিন্ন হতে পারে কিন্তু সংগ্রাম একই। আদিম ধারণা নারীদের পিছিয়ে রাখার ধারণা পাল্টে দিতেই জয়িতার প্রচলন। নারীরা আর্থিক ও সামাজিকভাবে স্বাবলম্বী না হলে তার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয় না। মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয় নারী ও শিশুর শারিরিক, মানসিক,অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়ন মানে নারীর সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার।’

অনুষ্ঠানে উপস্থিত অন্যান্য বক্তারা বলেন, জয়িতা মানে বিজয়ী। পরাজয়ে ভেঙ্গে না পড়ে অদম্য মনোবলে প্রতিকূলতা পেরিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া নারীরাই জয়িতা। প্রতিকূলতা, নির্যাতন,অবহেলা পেরিয়ে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিতদের সংগ্রামের করুণ গল্প শুনে এলজিইডি ভবনের হল ভর্তি দর্শকের অনেককে চোখে জল মুছতে দেখা যায়। জেন্ডার বৈষম্যহীন সুন্দর ও বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলতে হলে নারীর ক্ষমতায়নের বিকল্প নেই। মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের চেয়ে বেশি মানুষকে পিছিয়ে রেখে দেশে প্রকৃত উন্নয়ন করা যায় না। দেশের উন্নয়নে নারী পুরুষ সমানভাবে এগুতে হবে।

অনুষ্ঠানে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বদরুন নেছা, বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান, এগারো জেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সিএম/এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!