সাদ-মুসা গ্রুপের অভিনব ‘প্রতারণায়’ পথে বসলো ব্যবসায়ীরা

পার্কিংয়ে দোকান, আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান

অষ্টম তলা ভবনের প্রথম তলায় ছিল ছয় সংখ্যালঘুসহ সাত ব্যবসায়ীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আর নিচ তলায় (গ্রাউন্ড ফ্লোর) ছিল পার্কিং। ভবনের পাশের সড়ক উঁচু করার পর নিচ তলা ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। অন্যদিকে ভবনের মালিক অনুমোদন না নিয়েই এক তলা বাড়িয়ে নবম তলা করে ফেলে। এ সুযোগে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে প্রথম তলাকে নিচ তলা দেখিয়ে উচ্ছেদ করা হয় সাতজন ব্যবসায়ীকে। আর এই উচ্ছেদে সহযোগিতা করেছেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) কিছু অসাধু কর্মকর্তা।

ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ হওয়ার পর মালিক পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ না পাওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন উচ্ছেদ হওয়া সংলখ্যালঘু ব্যবসায়ীরা। এখানেই শেষ নয়। বর্তমানে গ্রাউন্ড ফ্লোরে দোকান ভাড়া চালু করা হয়েছে। আবাসিক ভবনে চালানো হচ্ছে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়। ভবনের সামনে বসানো হয়েছে কাঁচামালের দোকান। এসব অভিযোগ দেশের স্বনামধন্য শিল্পগ্রুপ সাদ মুসা গ্রুপের বিরুদ্ধে।

সাদ-মুসা গ্রুপের অভিনব 'প্রতারণায়' পথে বসলো ব্যবসায়ীরা 1

জানা যায়, ২০০১ সালে চট্টগ্রামের কোতোয়ালী থানাধীন সিরাজউদ্দৌলা রোডের সাব-এরিয়া এলাকায় রোকেয়া হেরিটেজ নামের (৮ম তলা) ভবনের প্রথম তলা বরাদ্দের জন্য অর্থ জমা দেন সংখ্যালঘু ব্যবসায়ী প্রণব চৌধুরী, লিটন কান্তি সেন, অনুরূপ পাল, অ্যাপোলো চৌধুরী, রীমা পাল (পক্ষে ডা. সমীর কুমার পাল), মনছুর আলী এবং মিতা মজুমদার। এর মধ্যে অনুরূপ পাল ৩ লাখ টাকা এবং বাকিরা আড়াই লাখ টাকা করে জমা দেন। সে সময়ে ভবনটির মালিকানায় ছিলেন এসএম মঈনুল হক, এসএম সাঈদুল হক ও এসএম এহতেশামুল হক।

২০০৮ সালে সাত কোটি টাকার ভবনটি মাত্র এক কোটি টাকায় কিনে নেয় সাদ মুসা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মহসীন। এরপর থেকেই ভাড়া নিয়ে বনিবনা না হওয়ায় ওই সাত ব্যবসায়ীকে উচ্ছেদ করার ফন্দি আঁটে সাদ মুসা গ্রুপ। অভিযোগে জানা যায়, সিডিএর কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে ২০১৫ সালের ১ ডিসেম্বর বিনা নোটিশে ওই সাত ব্যবসায়ীর দোকান উচ্ছেদ করায় সাদ মুসা গ্রুপ। এর আগে ২০১৫ সালের ৩০ নভেম্বর দালানের প্রথম তলায় স্থিত দোকান না ভাঙ্গার জন্য এবং দোকানঘর রক্ষা করার জন্য সিডিএ চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করেছিলেন ওই ব্যবসায়ীরা। এরপরও উচ্ছেদ হয়ে দিশেহারা হয়ে যান ওই ব্যবসায়ীরা। লাখ লাখ টাকার মাল নষ্ট হয়ে যায় তাদের।

সাদ-মুসা গ্রুপের অভিনব 'প্রতারণায়' পথে বসলো ব্যবসায়ীরা 2

সরেজমিনে দেখা যায়, ‘রোকেয়া হেরিটেজ’ ভবনে গ্রাউন্ড ফ্লোরে পার্কিংয়ের স্পেসে দোকান ভাড়া দিয়েছে সাদ মুসা গ্রুপ। এতে ‘সাতকানিয়া হোটেল’ নামের একটি হোটেল ও একটি মুরগির দোকান দেওয়া হয়েছে। ভবনের সামনে বসানো হয়েছে কাঁচামালের দোকান। আবাসিক ভবনটিতে পরিচালিত হচ্ছে দুটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কার্যাবলী। একটি গোল্ডেন ব্রেইন স্কুল এবং অন্যটি নিদাউল হারামাইন হজ কাফেলা। সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন, ‘ফার্স্ট ফ্লোরেও দোকান ভাড়া দেওয়ার পাঁয়তারা করছে সাদ মুসা গ্রুপ।’

উচ্ছেদ হওয়া সাত ব্যবসায়ীর মধ্যে মনসা জেনারেল স্টোরের স্বত্বাধিকারী অনুরূপ পাল চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ওই ভবনে গ্রাউন্ড ফ্লোরে পার্কিংয়ের স্পেসে দুটি দোকান চালু করা হয়েছে। ভবনে দুটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। প্রথম তলায় দোকান ছিল সাতটি। ওটা পার্কিং স্পেস ছিল না। সাদ মুসা গ্রুপের সাথে দুই বার বৈঠক হয়েছে আমাদের। ঘর ভাড়া মামলা তুলে নিতে বলেছিল তারা। আগে জমা দেওয়া সেলামি অগ্রিম হিসেবে থাকার কথা। তিন হাজার টাকা করে ভাড়া চেয়েছিল তারা। বনিবনা না হওয়ায় সিডিএর সহযোগিতায় আমাদের উচ্ছেদ করা হলো। কোন ক্ষতিপূরণ দেয়নি। অনুমোদন আট তলার ছিল। এক তলা বাড়িয়ে নয় তলা করেছে, ফার্স্ট ফ্লোর পার্কিং দেখানোর জন্য। সিডিএর সাথে যোগসাজশ করে আবাসিকে বাণিজ্যিক ব্যবহার দেখিয়ে আমাদের দোকান ভাঙ্গিয়েছে সাদ মুসা গ্রুপ। টাকার অভাবে মামলাও চালাতে পারছি না।’

সাদ-মুসা গ্রুপের অভিনব 'প্রতারণায়' পথে বসলো ব্যবসায়ীরা 3

অনুরূপ পাল কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি আমার দোকান চাই। তারা আমার ৫ লাখ টাকার মালপত্রগুলো নষ্ট করে দিলো। দোকানগুলো দখল করে রাখলো। পরিবার নিয়ে খুব কষ্টের মধ্যে আছি। অসুস্থ মা মৃত্যুশয্যায়। বাচ্চাদের পড়ালেখা চালাতে পারছি না। দোকানটা করতে চাচ্ছি। দেবে দেবে বলেও দিচ্ছে না সাদ মুসা গ্রুপ।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘নতুন ভবন মালিক উচ্ছেদ হওয়া ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণ দেবে অথবা আগের মালিক থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করে দেবেন।’

ভবনটির আগের মালিকদের একজন এসএম সাঈদুল হক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, দোকানদারদের ক্ষতিপূরণ সাদ মুসা গ্রুপই দেবে। ভবন বিক্রি বাবদ সাদ মুসা গ্রুপ থেকে মোট অর্থের মধ্যে ১৭ লাখ টাকা আমরা নিইনি। ওই টাকা দোকানদারদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া কথা। সাদ মুসা গ্রুপ দিল না কেন তা জানি না। সাদ মুসা গ্রুপের এমডি আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনি ২০০ টাকা, ৩০০ টাকা ভাড়া নিচ্ছেন। এটা উচিত নয়। আমি ভাড়া বাড়াবো।’

সাঈদুল হক বলেন, ‘সাদ মুসা গ্রুপের অবশ্যই দোকানদারদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত। আমি এটা সাদ মুসা গ্রুপের এমডিকেও বলেছি।’

সিডিএর অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করা সম্পর্কে জানতে চাইলে সিডিএর অথরাইজড কর্মকর্তা-২ মোহাম্মদ শামীম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এটা অনেক আগের কথা। ফাইল না দেখে কিছু বলতে পারছি না। নকশা দেখলে বলতে পারবো, কোনটা গ্রাউন্ড ফ্লোর আর কোনটা ফার্স্ট ফ্লোর। এখন আমাদেরকে কেউ অভিযোগ দিলে আমরা ব্যবস্থা নেবো। কারো পক্ষ নেবো না।’

বর্তমানে ওই ভবনে পার্কিংয়ের স্থলে দোকান এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে মোহাম্মদ শামীম বলেন, ‘আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক কার্যাবলীর বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান আছে। মামলা, জরিমানা ও উচ্ছেদ রুটিনমাফিক চলছে।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সাদ মুসা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মহসীন মুঠোফোনে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘ওই দোকানদারেরা আট বছর আমাকে কোন ভাড়া দেয়নি। আমার বিরুদ্ধে আদালতে ৩২ মামলা করেছি। আদালতই ফয়সালা করেছে।’

পার্কিংয়ের স্থানে দোকান এবং আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওখানে আমি কোন দোকান ভাড়া দেইনি। দোকান থাকলে আপনি পত্রিকায় লিখে দেন।’ এই বলে তিনি রাগত স্বরে মুঠোফোনের লাইন কেটে দেন।

এমএ/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!