সাতকানিয়া পৌরসভার দুই কর্তার ‘টাকার খনি’, যৌথ একাউন্টেই কোটি কোটি টাকার লেনদেন

এদের একজন পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী, আরেকজন হিসাবরক্ষক। অল্প বেতনের এই দুই সরকারি কর্মকর্তার আবার আছে যৌথ ব্যাংক একাউন্টও। সেই একাউন্টে ২২ মাসে লেনদেন হয়েছে ৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা। অন্যদিকে হিসাবরক্ষকের ব্যক্তিগত একাউন্টে গত কয়েক বছরে ঢুকেছে মাত্র ৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা! আবার সহকারী প্রকৌশলীর বৃদ্ধা মায়ের একাউন্টেও লেনদেন হয়েছে কয়েক কোটি টাকার। এ তো গেল স্বনামে পাওয়া একাউন্ট। বেনামে ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা ব্যাংক একাউন্টেও বিস্তর লেনদেন করেছেন গুণধর এই দুই কর্মকর্তা। সবমিলিয়ে অন্তত অর্ধশত কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে দুজনের বিভিন্ন একাউন্টে— এমন দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা

সাতকানিয়া পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী বিশ্বজিত দাশ ও হিসাবরক্ষক এএইচএম আলমগীরের বিরুদ্ধে ব্যাংক একাউন্ট ছাড়াও নগদে কোটি কোটি টাকার লেনদেনের এমন গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। অবৈধ এই লেনদেনের ‘স্বচ্ছতা’ রাখতে গিয়ে দুজনে আবার খুলেছেন যৌথ ব্যাংক একাউন্টও। অথচ কোটি কোটি টাকার লেনদেন করা এই দুজনের মধ্যে মধ্যে সহকারী প্রকৌশলী বিশ্বজিত ৭ম গ্রেডভুক্ত এবং হিসাবরক্ষক আলমগীর ১২তম গ্রেডভুক্ত কর্মচারী।

জানা গেছে, এনসিসি ব্যাংক কেরানীহাট শাখায় সহকারী প্রকৌশলী বিশ্বজিত দাশ এবং হিসাবরক্ষক এএইচএম আলমগীরের যৌথ একাউন্টে (নম্বর ০০৫৮০৩২০০০১২৯০) ২০১৮ সালের ২৯ জানুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ মাসে লেনদেন হয়েছে ৩ কোটি ২৮ লাখ ৯৪ হাজার ৮১৭ টাকা। এনসিসি ব্যাংকের ওই শাখায় আলমগীরের ব্যক্তিগত একাউন্টে (নম্বর ০০৫৮০৩১০০০৯৫২৪) ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জমা হয়েছে ৪ কোটি ৪৯ লাখ ২০ হাজার ৪৮৫ টাকা। একই সময়ে উত্তরা ব্যাংক লোহাগাড়া শাখায় সহকারী প্রকৌশলী বিশ্বজিত দাশের মা শোভা রানী দাশের নামে গড়ে তোলা ‘শোভা এন্টারপ্রাইজের’ একাউন্টে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে।

এছাড়া জানা গেছে, সাতকানিয়ার কেরানীহাট ও লোহাগাড়ায় দুজনেরই ব্যক্তিগত ও ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে রয়েছে একাধিক ব্যাংক একাউন্ট। সেখানেও অস্বাভাবিক লেনদেন হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।

নকশাকারক হিসেবে লামা পৌরসভায় চাকরিজীবন শুরু করা বিশ্বজিত দাশ বর্তমানে সাতকানিয়া পৌরসভার সহকারী প্রকৌশলী। অন্যদিকে সাতকানিয়া পৌরসভা প্রতিষ্ঠার পর থেকে হিসাবরক্ষক পদে চাকরি করে আসছেন এএইচএম আলমগীর। দীর্ঘদিন ধরে সাতকানিয়া পৌরসভায় একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে কর্তাব্যক্তিদের প্রশ্রয়ে দুজনে গড়ে তুলেছেন অবিচ্ছেদ্য সিন্ডিকেট।

জানা গেছে, সহকারী প্রকৌশলী বিশ্বজিত দাশ এবং হিসাবরক্ষক এএইচএম আলমগীর দীর্ঘদিন ধরে সাতকানিয়া পৌরসভাভিত্তিক ঠিকাদারি কাজ ছাড়াও বিভিন্ন কাজ নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। বর্তমানেও চট্টগ্রামের সাতকানিয়া-লোহাগাড়া ছাড়াও বান্দরবান ও কক্সবাজারে তাদের কোটি কোটি টাকার ৮টি ছোট-বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। প্রকল্পগুলো হলো সাতকানিয়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (নতুন ভবন), মডেল মসজিদ বান্দরবান বালাঘাটা, সাতকানিয়া পৌরসভা ২নং ওয়ার্ডে আরসিসি সড়ক নির্মাণ, কক্সবাজার পৌরসভার আরসিসি ড্রেন, সাতকানিয়া পৌরসভার কাশিমবাড়ি পুকুর রিটেইনিং ওয়াল, সাতকানিয়া পৌরসভার কাশিমবাড়ি বদ্দাপাড়া আরসিসি সড়ক ৫নং ওয়ার্ড, সাতকানিয়া পৌরসভার মধ্যম ছিটুয়াপাড়া আমিন এসবি বাড়ি আরসিসি সড়ক এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) অধীনে লোহাগাড়া ব্রিকফিল্ড সড়কের নির্মাণ কাজ।

ছিটুয়াপাড়ার আর সি সি সড়কের বিষয়ে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি আশেক হাসান বলেন, ‘ছিটুয়া পাড়া সড়কের টেন্ডার হিসাবরক্ষক আলমগীর নিজেই নিয়ে লোহার পরিবর্তে মাঝে মাঝে বাঁশ ঢুকিয়ে দিচ্ছে। আর কিছু কিছু জায়গায় লোহাও দেয়নি। সে বিরাট দুর্নীতিবাজ।’

এদিকে এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সহকারী প্রকৌশলী বিশ্বজিত দাশের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা না গেলেও হিসাবরক্ষক এএইচএম আলমগীর বলেন, ‘পৈত্রিক সম্পত্তি বিক্রি, আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় টাকা ধার নিয়েছি। আবার দিয়েছিও। যার ফলে ৩ থেকে ৪ বছরের লেনদেনের কারণে হিসাবের অংকটা বড় দেখাচ্ছে।’

সহকারী প্রকৌশলী বিশ্বজিত ও তার বাড়ি দুই জায়গায়। কিন্তু একই ব্যাংকে যৌথ একাউন্ট কেন— এমন প্রশ্নের জবাবে হিসাবরক্ষক আলমগীর বলেন, ‘বিশ্বজিত দাশকে তার আত্মীয়স্বজন বিলিভ করে না। তাই আমাকে গ্রান্টেড রাখা হলো। সেই টাকা এগুলো।’

তার ইট-লোহা বিক্রির ব্যবসা আছে বলে স্বীকার করে আলমগীর বলেন, ‘টেন্ডারের কাজগুলো জোবায়ের ভাইয়ের।’

এই জোবায়ের কি সাতকানিয়া পৌরসভার মেয়র মোহাম্মদ জোবায়ের, নাকি অন্য কোনো জোবায়ের— এমন প্রশ্নের উত্তরে আলমগীর বলেন, ‘মেয়র জোবায়ের নাকি আরেক জোবায়ের সেটা তদন্ত করলে পাবেন।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!