‘সাজানো’ আসামি আদালতে আসলো বাদির গাড়িতে, আটকের সময় নিয়ে মিথ্যাচার

রোববার (২৫ আগস্ট) বিকেল ৩টা ৪৭ মিনিটে চট্টগ্রামের বন্দর থানার একটি গাড়ি থেকে চট্টগ্রাম আদালত চত্বরে একে একে নামিয়ে আনা হল ‌‘চুরির অভিযোগে’ আটক হওয়া তিন যুবককে৤ এরা হলেন সাজ্জাদ হোসেন টিপু, সুলতান আরেফিন জীবন এবং ইসমাইল হোসেন। তাদের সঙ্গে ছিলেন জেসমিন আক্তার ও রেহানা আক্তার নামের দুই নারী। সাজ্জাদ সবার ছিলেন সবার সামনে, তবে তিনি হাঁটতে পারছিলেন না। ইসমাইল হোসেন ও সুলতান আরেফিন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তখন তাকে অতিক্রম করছিলেন। সাজ্জাদ দায়িত্বরত এক পুলিশ সদস্যের কাঁধে হাত দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এগিয়ে গেলেন। এরপর সেখান থেকে তাদের নেওয়া হলো আদালতের জেনারেল শাখায়। সেখান থেকে সরাসরি আদালতের কাস্টডিতে।

এর ঠিক ১১ মিনিট পর আদালত চত্বরে প্রবেশ করল চট্টমেট্রো অ ০০-০১১৮ নম্বারের একটি হালকা ছাই রঙের প্রাইভেট কার। প্রাইভেট কার থেকে প্রথমে নামলেন এমপি লতিফের ভাইপো ও বন্দর থানায় দায়ের করা আলোচিত চুরি মামলার বাদী ফারজিন। এরপর নামলেন বন্দর থানার উপ-পরিদর্শক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম। রবিউল নামার পর প্রাইভেট কার থেকে নামলেন মামলার আরেক আসামি মো. শরিফ। তাকে সরাসরি মহানগর মূখ্য হাকিম আবু সালেম মো. নোমানের আদালতে হাজির করা হয়।


আদালতে হাজিরের আগে পুলিশি পাহারায় বন্দর হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয় আটক যুবক জীবনকে।

বিকেল ৫টা ১৫ মিনিটে আসামি শরীফকে আদালত থেকে নেওয়া হলো আদালতের কাস্টডিতে। শরীফকে কাস্টডিতে বুঝিয়ে দিয়ে এসআই রবিউল ইসলাম আদালত ত্যাগ করলেন আবার এমপি লতিফের ভাইপোর গাড়িতে করেই।

অভিযোগ রয়েছে, যে শরীফকে দিয়ে পুলিশ আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করিয়েছে সেই আসামি শরীফকে নিজেদের আয়ত্তেই রেখেছিল পুলিশ। তার মুখ দিয়েই সাজ্জাদ-জীবন-ইসমাইলসহ অন্যদের জড়িত থাকার কথা বলানো হয়েছে। সেজন্যই পুলিশের সাজানো কথা আদালতে বলানোর জন্য বাদির প্রাইভেট কারে আদালতে নিয়ে আসা হয়।


‘সাজানো’ আসামি শরিফ আসে বাদি ফারজিনের গাড়িতে। সঙ্গে ছিলেন এসআই রবিউল।

আলোচিত এই মামলায় আদালতে আসামি হাজির করার সময় শুধু এসব অনিয়মই নয়। গত তিন দিন ধরে থানায় আটকে রেখে সাজ্জাদ ও জীবন নামে দুই যুবককে নিষ্ঠুর নির্যাতন করেছে বন্দর থানা পুলিশ। বন্দর থানা পুলিশের পাঠানো প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সাজ্জাদ ও জীবনসহ অন্য চার আসামিকে গত ২৪ আগস্ট গ্রেপ্তারের কথা বলা হলেও চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে আসা সিসিটিভির ফুটেজে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, এস আই রবিউলের নেতৃত্বে সাদা পোশাকধারী একদল পুলিশ ও এমপি লতিফের ভাতিজা ফারজিনের নেতৃত্বে ২২ আগস্ট রাত পৌনে ৯টার দিকে নগরীর হোটেল লর্ডস ইনের সামনের একটি ইলেকট্রনিকস শো রুম থেকে জীবনকে আটক করা হয়। এরপর ধরে নেওয়া হয় সাজ্জাদকেও।

বন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সুকান্ত চক্রবর্তী রোববার (২৫ আগস্ট) চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘অভিযুক্তদের মধ্যে মো. শরিফ ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। আদালতে হাজির করা হলে আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। তদন্তের স্বার্থে যখন প্রয়োজন হবে তখনই তাদের রিমান্ডের আবেদন করা হবে।’

স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে শরিফ কী স্বীকার করেছে তা জানতে মামলার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রবিউল ইসলামের মুঠোফোনে ফোন করে জানতে চাইলে তিনি ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে এ বিষয় কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

পুলিশের বিরুদ্ধে এই মামলার আসামি সাজ্জাদ ও জীবনকে তিন দিন ধরে থানায় রেখে নিষ্ঠুর নির্যাতনের অভিযোগ পুলিশ বারবার অস্বীকার করলেও তাদের মধ্যে একজনকে আদালতে হাজিরের আগে বন্দর হাসপাতালে পুলিশি পাহারায় চিকিৎসা দেওয়ার ভিডিওচিত্রও চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে এসেছে।

‘সাজানো’ আসামি শরিফ আসে বাদি ফারজিনের এই গাড়িতে৤
‘সাজানো’ আসামি শরিফ আসে বাদি ফারজিনের এই গাড়িতে৤

উল্লেখ্য, বন্দর-পতেঙ্গা সংসদীয় আসনের সাংসদ এমএ লতিফের ভাই এমএ মজিদের বাসায় চুরির অভিযোগে বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) নগরীর জিইসি মোড় এলাকা থেকে আটক করা হয় সাজ্জাদ হোসেন টিপু ও সুলতান আরেফিন জীবনকে। তারপর আটক করা হয় ইসমাইলকে। পুলিশ টিপু ও জীবনকে ২২ আগস্ট আটক করলেও ২৪ আগস্ট আটক করা হয়েছে দাবি করেছে।

এই মামলা নিয়ে বন্দর থানা শুরু থেকেই লুকোচুরি করে আসছে। মামলার কোন নকল তো তাদের কাছে পাওয়াই যায়নি, কখন মামলা দায়ের হয়েছে সেই তথ্য জানতে চাইলে এড়িয়ে যায় পুলিশ।

তবে রোববার বন্দর থানার পক্ষ থেকে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ‘১৯ আগস্ট চুরির ঘটনায় ২০ আগস্ট মামলা দায়ের করা হয়। পুলিশ অভিযান চালিয়ে ছয়জনকে আটকের পাশাপাশি আট ভরি নয় আনা চার রতি স্বর্ণ ও চার লাখ ৩০ হাজার ৫০০ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।’

প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সুলতানুল আরেফিন জীবনকে চুরির ঘটনার মূল হোতা, সাজ্জাদ হোসেন টিপুকে মূল পরিকল্পনাকারী এবং মো. শরিফকে চুরির ঘটনা বাস্তবায়নকারি হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

এফএম/এডি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!