সাগরের নোনাজল হবে খাবার পানি, চট্টগ্রামের সন্তানের হাতে ‘ম্যাজিক’

চট্টগ্রামের সন্তান ড. রাসেল দাশ ও তার সহযোগী গবেষকদল সমুদ্রের লবণাক্ত পানিকে লবণমুক্ত করার প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছেন। এই প্রযুক্তি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারসহ দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোর কৃষিখাতে বিপ্লব আনবে বলে আশা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ প্রতি বছর প্রায় ১৪ লাখ হেক্টর আবাদি জমি সমুদ্রের লবণাক্ত পানিতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আর প্রতিবছরই ক্ষতির পরিমাণটা বাড়ে। যা সরাসরি আমাদের জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

গবেষকরা সমুদ্রের বর্জ্য হিসেবে গণ্য প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার করেছেন। আর এ ক্ষেত্রে তারা কোকাকোলার বোতল নিয়েই গবেষণা করেছেন। কোকাকোলার পরিত্যক্ত বোতল থেকে তারা একধরনের পলিমার ব্যবহার করেছেন। দামের দিক থেকে যা অনেক সাশ্রয়ী। যার ফলে পানি পরিশোধনে ব্যয় অনেকাংশে কমে যাবে।

কৃষি ছাড়াও তাদের তৈরি ফিল্টারটি সমুদ্রের পানিকে সরাসরি পানযোগ্য নিরাপদ পানিতে রূপান্তর করবে। এই ফিল্টার প্রতি স্কয়ার মিটারে প্রতিঘণ্টায় সমুদ্রের পানি থেকে প্রায় ২৫ লিটার নিরাপদ খাবারের পানি তৈরি করতে সক্ষম।

নিজেদের তৈরি এই প্রযুক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে ড. রাসেল দাশ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির দুটি দিক রয়েছে। প্রথমত সামুদ্রিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় একটা বড় পরিবর্তন আনবে। কারণ বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিকের দূষণ অপসারণ এই শতাব্দীর অনেক বড় একটি চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয়টি হলো সমুদ্রের লবণাক্ত পানিকে লবণমুক্ত করে নিরাপদ পানির চাহিদা পূরণ। যা কৃষিতে বিপ্লব আনার পাশাপাশি সুপেয় খাবারের পানির চাহিদা পূরণ হবে।’

সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, ইসরাইল, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স এবং মধ্যপ্রাচ্যের একাধিক দেশ সমুদ্রের পানি বিশুদ্ধ করে সেচ, কৃষি, শিল্প ও গার্হস্থ্য খাতে ব্যবহার করছে।

গবেষণার বিস্তারিত জানিয়ে ড. রাসেল আরও বলেন, ‘আমাদের গবেষণা টিম বোতল থেকে ইলেক্ট্রো-স্পুন প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে এমন একধরনের ন্যানোফাইব্রাস ফিল্টার তৈরি করেছে, যা দিয়ে ৯৯.৯% সমুদ্রের পানি পাতন প্রক্রিয়ায় লবণমুক্ত করা সম্ভব। এ প্রযুক্তিতে পানি পরিশোধন করা খুব ব্যয়বহুল। কারণ এ ধরনের ফিল্টার তৈরির জন্য অনেক মূল্যবান আর্টিফিশিয়াল পলিমার ব্যবহার করতে হয়। ব্যয় কমাতে আমরা এ ধরনের মূল্যবান পলিমার ব্যবহার না করে প্লাস্টিকের পরিত্যক্ত বোতল থেকে একধরনের পলিমার ব্যবহার করেছি।’

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পানি দূষিত হওয়ার কারণে বর্তমানে পৃথিবীর ৭০০ মিলিয়ন মানুষ নিরাপদ পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত। জাতিসংঘের আশঙ্কা, ২০২৫ সাল নাগাদ সেই সংখ্যা ১.৮ বিলিয়নে গিয়ে ঠেকবে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৪ মিলিয়ন মানুষ নিরাপদ পানির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তবে উপকূলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাস হলে সুপেয় পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করে।

ড. রাসেল দাশ গত অর্ধযুগেরও বেশি সময় মালয়েশিয়া, আমেরিকা এবং জার্মানিতে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করে সমুদ্রের পানি পরিশোধন করার লক্ষ্যে কাজ করছেন। তার এই কাজের জন্য ২০১৫ সালে তিনি ‘এলসেভিয়ার-এটলাস অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন। বর্তমানে তিনি জাপানের কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়ে জাপান সরকারের অধীনে পোস্ট-ডক্টরাল জেএসপিএস ফেলো হিসেবে কর্মরত আছেন। ড. রাসেল ও তার সহযোগী সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার ড. গুরং-শো এবং গবেষকদলের গবেষণাকর্মটি জার্নাল অব ওয়াটার প্রসেস ইঞ্জিনিয়ারিং নামে একটি বৈজ্ঞানিক সাময়িকীতে গত ৭ মে প্রকাশিত হয়েছে।

দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার নলুয়া ইউনিয়নের সন্তান ড. রাসেল দাশ চট্টগ্রাম বিজ্ঞানও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বায়ো-টেকনোলজিতে পোস্ট গ্রাজুয়েশন শেষ করে ২০১২ সালে সেখানেই প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন। পরে তিনি মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অফ মালয় থেকে পিএইচডি করেন।

রাসেল দাশের বাবা সাবেক স্বাস্থ্য পরিদর্শক মিলন দাশ। ব্যক্তিগত জীবনে এক কন্যা সন্তানের জনক রাসেলের স্ত্রী শায়ন্তনী দাশ তুহি একজন ব্যাংক কর্মকর্তা।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!