কঠিন বাস্তবতা/ ৫ শতাংশ নগদ সহায়তার ওপর পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ!

চট্টগ্রাম অঞ্চলেই কেবল বন্ধ হয়ে গেছে ৩৩৫টি গার্মেন্টস

বাংলাদেশে পোশাকশিল্প বর্তমানে একটি সংকটময় মূহুর্ত অতিক্রম করছে। অব্যাহত দরপতন, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি, রেমিডিয়েশন বাবদ ব্যয় বৃদ্ধি এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার সংগ্রামে পোশাকশিল্প ধীরে ধীরে সক্ষমতা হারাচ্ছে। সরকারি কম ভর্তুকিতেও অর্থনীতিতে বেশি অবদান ও প্রবৃদ্ধি দিয়ে যাচ্ছে পোশাকশিল্প। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এরপরও অবহেলার শিকার এ শিল্প। ফলে ক্রমেই কমছে এ শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা। এ পরিস্থিতিতে পোশাকশিল্পের বিনিয়োগ সুসংহত এবং শিল্পের বিকাশ অব্যাহত রাখতে এ শিল্পকে সহায়তা প্রদান জরুরি বলে মনে করছেন পোশাকশিল্পের ব্যবসায়ীরা।

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) সূত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে প্রস্তাবিত বাজেটে পোশাকশিল্পের জন্য ৫ শতাংশ প্রণোদনা প্রদানের দাবির বিপরীতে শুধুমাত্র এক শতাংশ বা অতিরিক্ত ২ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিজিএমইএ বলছে, ‘দাবির তুলনায় এটি অপ্রতুল।’

বিজিএমইএ তাদের বাজেট প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছে, ‘সামাজিক সুরক্ষাখাতে যে ৭৪ হাজার ৩৬৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, সেখানে পোশাকশিল্পের শ্রমিকদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। যদিও চলতি অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে পোশাকশিল্পে পূর্ববতী বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৮২ শতাং এবং লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৬ দশমিক ৯৫ শতাংশ বেশি। বাস্তবতা হলো এই শিল্পের প্রতিযোগী সক্ষমতা ক্রমেই কমছে।’

প্রাপ্ত তথ্যমতে, প্রধান নয়টি পণ্য রপ্তানিতে সরকার সবচেয়ে কম ভর্তুকি দেয় পোশাকশিল্পে। এরপরও এই নয়টি খাতের মধ্যে বেশি রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয় পোশাকশিল্পে। প্রবৃদ্ধিতে পোশাকশিল্পের চেয়ে এগিয়ে আছে শুধু চামড়া ও ফার্নিচার শিল্প। এই দুটি শিল্পে সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি দেয় সরকার। তবে টাকার অংকে রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে সব শিল্পকে ছাড়িয়ে গেছে পোশাক খাত। চার শতাংশ ভর্তুকিতে গত ১০ বছরে পোশাক খাতে (নতুন বাজার) রপ্তানি প্রবৃদ্ধির হার ৪৫০ শতাংশ (তিন হাজার ৮২১ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন ডলার)। অন্যদিকে ২০ শতাংশ ভর্তুকিতে কৃষি পণ্যে প্রবৃদ্ধি ১৯৪ শতাংশ (৪৪৪ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন ডলার); ৭ থেকে ১০ শতাংশ ভর্তুকিতে চিংড়িতে প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ (৩৩ দশমিক ৬৭ মিলিয়ন ডলার); ২ থেকে ৫ শতাংশ ভর্তুকিতে হিমায়িত মাছে প্রবৃদ্ধি মাইনাস ২৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ; ১০ শতাংশ ভর্তুকিতে প্লাস্টিকে প্রবৃদ্ধি ৮৮ শতাংশ (৪৬ মিলিয়ন ডলার); ১০ শতাংশ ভর্তুকিতে ফার্মাসিউটিক্যালে প্রবৃদ্ধি ১৮৬ শতাংশ (৬৭ মিলিয়ন ডলার); ১০ শতাংশ ভর্তুকিতে সিরামিকে প্রবৃদ্ধি ৬৬ শতাংশ (২১ মিলিয়ন ডলার); সবচেয়ে বেশি ১৫ শতাংশ ভর্তুকি পাওয়া চামড়া ও ফার্নিচারে প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে ৫০৯ শতাংশ (৯০৭ মিলিয়ন ডলার) এবং ৬১১ শতাংশ (৫৪ মিলিয়ন ডলার)।

বিজিএমইএ সূত্রে জানা যায়, গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে পোশাকশিল্পের অবদান ছিল প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের জীবনযাপনের আনুষঙ্গিক ব্যয় দেশে একটি বিশাল বাজার তৈরি করেছে; ২০১৭-১৮ অর্থবছরে যার পরিমাণ ৩৫ হাজার কোটি টাকা।

জানা যায়, এক সময় বাংলাদেশে বিজিএমইএর সদস্য পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল চার হাজার ৫৬০টি। এদের মধ্যে বর্তমানে চালু রয়েছে দুই হাজার ৬৫৩টি প্রতিষ্ঠান। গত ২০ বছরে বন্ধ হয়ে গেছে এক হাজার ৯০৭টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্স এবং আইএলওর কারণে বন্ধ হয়েছে ৮৮৭টি প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে বিজিএমইএ চট্টগ্রাম অঞ্চলে মোট সদস্য প্রতিষ্ঠান ছিল ৬৮৬টি। এদের মধ্যে চালু প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৩৫১টি। বন্ধ হয়ে গেছে ৩৩৫টি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ১৫৩টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছে অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্স এবং এনএপি (আইএলও) এর কারণে।

বিজিএমইএর পরিচালক মোহাম্মদ আতিক বলেন, ‘প্রতি বছর গড়ে ১০০টি গার্মেন্টস সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গত রোজার ঈদে আগেও ২০টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে।’

এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘যে কোনো জায়গায় এখন গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে না। ক্রেতাদের নতুন নতুন কমপ্লায়েন্স ইস্যু, শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো খরচ মেটাতে পারছে না। ছোট ও মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলো দাম পাচ্ছে না।’

জানতে চাইলে বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি এএম চৌধুরী সেলিম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রত্যক্ষভাবে ৪৫ লাখ এবং পরোক্ষভাবে প্রায় ২ কোটি মানুষ পোশাকশিল্পের সঙ্গে জড়িত। চার শতাংশ ভর্তুকির বিপরীতে আমাদের প্রবৃদ্ধি ৩৪ মিলিয়ন ডলার। পাঁচ শতাংশ ভর্তুকি পেলে এটি ৪০ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি, পরিবহন খরচ, বন্দর চার্জ, ব্যাংক সুদ সবকিছু মিলিয়ে পোশাকশিল্পে ব্যয় বাড়ছে। পক্ষান্তরে আন্তর্জাতিক বাজারে পোশাকের দাম পাচ্ছি না আমরা। পোশাকশিল্প বেঁচে না থাকলে দেশের অর্থনীতি পড়ে যাবে। তাই পোশাকশিল্পে ৫ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়ার বিষয়টি বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টি সরকার যেন পুনঃবিবেচনা করে—এটা আমাদের দাবি।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!