সর্বোচ্চ স্কোর করেও লড়াকু বাংলাদেশ ধরতে পারেনি অস্ট্রেলিয়াকে

মুশফিকের সেঞ্চুরিতে আশা জাগালেও শেষরক্ষা হয়নি

বড় আশা ছিল বঙ্গোপসাগরের ঢেউ আছড়ে পড়বে তাসমানিয়ার ওপারে। সাগরে যথেষ্ট ঢেউয়ের তৈরি হয়েছিল, যাতে ভারত মহাসগরও পাড়ি দেয়া সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু নিজেদের জ্বালানির সর্বোচ্চটাই ব্যবহার করেও তাসমানিয়ার ওপারে আর পৌঁছাতে পারেনি বাংলাদেশ। ৪৮ রানে হারা ম্যাচে প্রতিযোগিতা হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। জিততে পারতো বাংলাদেশও-এমন কিছু বললে অনেকেই হয়তো অবিশ্বাসের চোখে তাকাবেন! কিন্তু স্কোরকার্ড দেখে নয়, যারা এই ম্যাচ দেখেছে তারা নিশ্চিত জানেন ৩৮১ রানের পিছু ধাওয়া করতে নেমে এই ম্যাচে বাংলাদেশেরও সম্ভাবনা ছিলো।

আসলে অস্ট্রেলিয়া শুধু এই ম্যাচ জিতলো অংকের খাতায়। বাংলাদেশ যা জিতলো তার নাম-লড়াই। তার নাম-সাহস! অস্ট্রেলিয়ার ৩৮১ রানের জবাবে বাংলাদেশ তুললো ৮ উইকেটে ৩৩৩।

বিশ্বকাপে নিজের প্রথম সেঞ্চুরি আনন্দ উদযাপন হয়তো মুশফিক করতে পারলেন না। তবে তার এই সেঞ্চুরি এবং গোটা ম্যাচে বাংলাদেশের সম্মিলিত ব্যাটিং আরেকবার জানিয়ে দিলো-এই বাংলাদেশ ক্রমশই বিস্মিত করছে ক্রিকেট বিশ্বকে!

অস্ট্রেলিয়ার হৃদকম্প এতদুর থেকেও ঠিক শোনা যাচ্ছিলো! ৩৮১ রান তুলেও অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদের টেনশন এবং সাদা চেহারা আরো ‘সাদা’ হয়ে যাওয়া ঠিকই টের পাওয়া গেলো! মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ব্যাটিং নড়িয়ে দিলো অস্ট্রেলিয়ার ভিত। এবং সত্যিকার অর্থে বললে ম্যাচের একসময় অজিরা ঠিকই ‘ভীত’ হয়ে পড়েছিলো হারের ভয়ে!

হ্যাঁ স্কোরবোর্ডে ৩৮১ রান জমা করেও! যে ক্লাসিক কায়দায় মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ রান তাড়া করছিলেন পঞ্চম উইকেটে বাংলাদেশের সেই জুটিই অস্ট্রেলিয়ার শিড়দাড়ায় ভয়ের একটা স্রোত বইয়ে দেয়; হারের!

সর্বোচ্চ স্কোর করেও লড়াকু বাংলাদেশ ধরতে পারেনি অস্ট্রেলিয়াকে 1
লড়াইয়ের শুরুটা হয়েছিল তামিম ইকবালকে দিয়ে। যদিও চাহিদার তুলনায় কিছুটা শ্লথ ছিল তামিমের ইনিংসটি।

এই ম্যাচের শেষভাগ পুরোপুরি টি-টুয়েন্টি মেজাজের হয়ে দাড়ায়। ম্যাচ জিততে বাংলাদেশের শেষ ৩৬ বলে চাই ৯৩ রান। তখনো অনেক বড়ো টার্গেট। কিন্তু ম্যাচের আগে দিন বলা মাশরাফির সেই কথাটা যে এই বাংলাদেশ দলের সব ক্রিকেটারদের অন্তরের বিশ্বাস-‘কাজটা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়; লড়বে বাংলাদেশ।’

সত্যিকার অর্থেই লড়লো বাংলাদেশ। অস্ট্রেলিয়ার ৩৮১ রানের পিছু তাড়া করতে নেমে বাংলাদেশের শুরুটা ভালো হয়নি। ২৩ রানে ভাঙ্গে ওপেনিং জুটি। রান আউট হয়ে ফিরেন সৌম্য সরকার। তামিম ও সাকিব দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে সেই সমস্যা কাটিয়ে উঠছিলেন। দুজনে বেশ চমৎকার কায়দায় দলের ইনিংসকে সামনে বাড়াচ্ছিলেন। সাকিব টুর্নামেন্টে আরেকটি হাফসেঞ্চুরির কাছে পৌছে গিয়েছিলেন। কিন্তু স্টয়নিসের একটি স্লোয়ার বুঝতে না পেরে ব্যাটের কানা বল লাগিয়ে ক্যাচ তুলে দেন। ৪১ বলে ৪১ রান করে ফেরেন সাকিব। চলতি বিশ্বকাপের পাঁচ ম্যাচে এই প্রথম সাকিব অন্তত হাফসেঞ্চুরি নিচে আউট হলেন।

সর্বোচ্চ স্কোর করেও লড়াকু বাংলাদেশ ধরতে পারেনি অস্ট্রেলিয়াকে 2
বিশ্বকাপে দুর্দান্ত খেলতে থাকা বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান ৪১ রানে আউট হয়ে বিশ্বকাপে টানা পাঁচবার পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস খেলার সুযোগ হারান।

তামিম ইকবাল অবশ্য চলতি টুর্নামেন্টে নিজের হাফসেঞ্চুরি পেলেন। কিন্তু ইনিংসটা ৬২ রানের চেয়ে বেশি বড়ো করতে পারলেন না। পাঁচে ব্যাট করতে নামা লিটন দাসকে বাউন্সার দিয়েই স্বাগত জানালো অস্ট্রেলিয়া!

মিচেল স্টার্ক প্রথম বলটাই শর্ট দিলেন। বাউন্সার! লিটন মাথা নিচু করে সেই বাউন্সার এড়ানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু সফল হলেন না। বল সোজা গিয়ে লাগলো তার হেলমেটে। বলের ধাক্কায় লিটন তাল সামাল দিতে পারলেও হেলমেট খুলে ফেলেন। বলের ধাক্কাটা লাগে তার হেলমেটের একপাশে। মাথা ঝাঁকুনি দিতে থাকেন লিটন। কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা- সেটা জানার জন্য সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসক মাঠে ছুটেন। বারকয়েক লিটনকে পরীক্ষা করে চিকিৎসক যখন দেখলেন কোনো সমস্যা হয়নি। তখন আবার খেলা শুরু করেন আম্পায়ারা। তবে স্টার্কের বাউন্সারে ক্ষতিগ্রস্ত হেলমেটটা বদলে ফেলেন লিটন।

আগের ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুর্দান্ত ব্যাটিং করা লিটন দাসকে এই ম্যাচে ভালোই হোমওয়ার্ক করে নেমেছিলো অস্ট্রেলিয়া। লিটন ব্যাট হাতে পাল্টা হামলা চালাতে পছন্দ করেন সেটা জেনে গেছে অস্ট্রেলিয়া। তাই শুরুতেই লিটনের আত্মবিশ্বাস যাতে নড়িয়ে দেয়া যায় সেজন্যই স্টার্ক তাকে প্রথম বলেই বাউন্সার দেন।

পরের ওভারেই অন্যপ্রান্ত থেকে প্যাট কামিন্সকেও আক্রমণে আনেন অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক অ্যারেন ফিঞ্চ। দু’প্রান্ত থেকে নিজের দলের সেরা ফাস্ট বোলারকে বাংলাদেশের ইনিংসের মাঝপথে আক্রমণে আনার উদ্দেশ্যই হলো গতির চোটে বাংলাদেশকে সঙ্কটে ফেলা।

লিটন দাস তিন বাউন্ডারিতে এই ম্যাচেও শুরুটা ভালোই করেছিলেন। কিন্তু স্পিনার অ্যাডাম জাম্পার বলে এলবি হলেন ২০ রান তুলে। মুশফিকের সঙ্গে এসে জুটি বাঁধলেন মাহমুদউল্লাহ। এই দুজনের ব্যাটে যা মিললো তার নাম-সাহস! তার নাম- জেতার জেদ! অসম্ভব সুন্দর ব্যাটিং করেন দুজনে বাংলাদেশকে রানকে যেভাবে সামনে বাড়ালেন তাতে অস্ট্রেলিয়ার ৩৮১ রানের স্কোরকে খুব দুরের পথ মনে হচ্ছিলো না!

দুজনেই দলের ব্যাটিংকে ম্যাচের একদম গভীর পর্যন্ত নিয়ে যাবার পরিকল্পনা করলেন। দারুণভাবে তাতে সফলও হলেন। রক্ষনের সঙ্গে আক্রমণের মিশেল-ক্লাসিক ভঙ্গির এই ব্যাটিংয়ে জুটিতে যোগ হলো ১২৭ রান। তাও আবার মাত্র ১৬.১ ওভারে! মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ৫০ বলে ৬৯ রান করে।

শেষের টি-টুয়েন্টির আদলে সাব্বির রহমানের জন্য মঞ্চ তৈরি তখন। চাই ২৭ বলে ৮০ রান। কিন্তু সাব্বির রহমান যে এই মহাগুরুত্বপূর্ণ সময়ে প্রথম বলেই আউট! দুই বলে দুই উইকেট তুলে নিয়ে কোল্টার-নাইল মুলত ওখানেই অস্ট্রেলিয়ার জয়টা নিশ্চিত করে দিলেন।

আগের দিন লড়াইয়ের কথা বলা মাশরাফির আরেকটি কথা মনে পড়লো এদিন ম্যাচ শেষে-‘৩৩০/৩৪০ রান তাড়া করা যায়, কিন্তু প্রতিপক্ষের স্কোর ৩৭০/৩৮০ হয়ে গেলে সেটা তখন…। অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে তো সেটাই হলো! –বার্তা ২৪।

ক্যাচ মিস তো ম্যাচ মিস! এই কথার অর্থটা মর্মে মর্মে বাংলাদেশকে টের পাইয়েছেন ডেভিড ওয়ার্নার। পঞ্চম ওভারে মাশরাফীর অফস্টাম্পের বাইরের বল কাট করেন ওয়ার্নার, সেই বল বাতাসে ভেসে চলে যায় ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টে দাঁড়ানো সাব্বিরের কাছে। ঝাঁপ দিলেও বল তালুবন্দি করতে ব্যর্থ হন এই বিশ্বকাপে প্রথমবার ম্যাচ খেলতে নামা সাব্বির। তাতেই ওয়ার্নের কেল্লাফতে!

সর্বোচ্চ স্কোর করেও লড়াকু বাংলাদেশ ধরতে পারেনি অস্ট্রেলিয়াকে 3
সাব্বিরের হাতে জীবন পাওয়ার পর নিজের ব্যাটকে তরবারির মতো চালিয়ে টানা দ্বিতীয় শতকের দেখা পেয়ে যান ওয়ার্নার।

সাব্বির যখন ক্যাচ ছাড়েন তখন ওয়ার্নের রান মাত্র ১০। শেষ পর্যন্ত সৌম্যের মাথার উপরের বল টেনে মারতে গিয়ে রুবেলের হাতে আউট যখন হলেন তখন অজি ব্যাটসম্যানের রান ১৬৬ আর অস্ট্রেলিয়ার ৩১৩। সাব্বিরের এক হাফ চান্সকে ফুল করতে না পারার সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের জন্য কবর খুঁড়ে তবেই ফিরলেন ওয়ার্নার।

ওয়ার্নার ফেরার পর তার ফেরারি আরও বেশি গতিতে চালাতে শুরু করেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। রানআউটের বাধায় থামে ম্যাক্সি ঝড়। মাত্র ১০ বলে ৩১ রান করে খাজার সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির পর রুবেলের সরাসরি থ্রোতে আউট হন ম্যাক্সওয়েল।

ওয়ার্নারের সেঞ্চুরির এক ফাঁকে নিজের ১১তম হাফসেঞ্চুরি তুলে নেন খাজা। পাঁচ ম্যাচ পর বাংলাদেশের সঙ্গে এসে ফিফটির দেখা পান বাঁহাতি এ ব্যাটসম্যান। শেষ পর্যন্ত ফিফটিকে সেঞ্চুরিতে রূপ দিতে পারেননি খাজা। মুশফিকের হাতে ক্যাচ দিয়ে সৌম্যর তৃতীয় শিকার হওয়ার আগে ৮৯ রান করেন। তার ৭২ বলের ইনিংস সাজানো ১০টি চারে।

সর্বোচ্চ স্কোর করেও লড়াকু বাংলাদেশ ধরতে পারেনি অস্ট্রেলিয়াকে 4
বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো বল হাতে তুলে নিয়ে ৩ উইকেট তুলে নিয়ে দলের সেরা বোলার তকমা পেলেন সৌম্য সরকার।

৪০-৪৭, এই সাত ওভারে ১০৪ রান তুলে চারশ’র দিকে যাচ্ছিল অস্ট্রেলিয়া। কিন্তু এই সময়ে দ্রুত চার উইকেট তুলে নেয়ায় সেটা আর হয়নি। ম্যাক্সওয়েলের পর দুই বল খেলে ফেরেন স্টিভেন স্মিথও (১)।

প্রথম পাঁচ ম্যাচে সাত উইকেট পেয়েছেন মোস্তাফিজ। কিন্তু ইনিংসের ৩০ ওভার শেষ হওয়ার আগে একটিও উইকেট নিতে পারেননি। এই ম্যাচেও তাই। ইনিংসের ৪৭তম ওভারে পান উইকেটের দেখা। তার স্লোয়ার বুঝতে না পেরে এলবিডব্লিউ হন স্মিথ। শেষদিকে মার্কাস স্টয়নিস ১১ বলে ১৭ এবং অ্যালেক্স ক্যারির ১১ রানে ৫ উইকেটে ৩৮১ রান দাঁড়ায় অস্ট্রেলিয়ার।

বিশ্বকাপে মুশফিকের প্রথম, বাংলাদেশের পঞ্চম সেঞ্চুরি

সর্বোচ্চ স্কোর করেও লড়াকু বাংলাদেশ ধরতে পারেনি অস্ট্রেলিয়াকে 5
বিশ্বকাপে নিজের প্রথম ও বাংলাদেশের পঞ্চম সেঞ্চুরির পর মুশফিকুর রহিম

বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম চার আসরে কোনো সেঞ্চুরির দেখা পায়নি বাংলাদেশ। গত আসরে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের ব্যাটে খাতা খোলে টাইগাররা। এবার সবকিছুকে ছাপিয়ে যাচ্ছে লাল-সবুজরা। বৃহস্পতিবার অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন মুশফিকুর রহিম। চলতি বিশ্বকাপে এটি বাংলাদেশের তৃতীয় সেঞ্চুরি, সবমিলিয়ে পঞ্চম, আর মুশফিকের প্রথম।

বিশ্বকাপের দ্বাদশ আসরে সাকিব আল হাসান বাংলাদেশের হয়ে দুটি সেঞ্চুরি করেছেন। ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ব্যাক-টু-ব্যাক সেঞ্চুরি করেন তিনি। মুশি এদিন তিনঅঙ্কের ম্যাজিক ফিগার স্পর্শ করায় চলতি বিশ্বকাপে টানা তিন ম্যাচে সেঞ্চুরির দেখা পেল বাংলাদেশ। গত আসরে মাহমুদউল্লাহ টানা দুই ম্যাচে শতক তুলে নিয়েছিলেন।

দুর্দান্ত সেঞ্চুরির পথে পঞ্চম উইকেটে মাহমুউল্লাহ রিয়াদকে নিয়ে ৯৭ বলে ১২৭ রানের অনবদ্য জুটি গড়েছেন মুশফিক। মাহমুদউল্লাহ, সাব্বির রহমান ও মেহেদী হাসান মিরাজ পরপর আউট হওয়ার পর নিজের শতক পূর্ণ করেন তিনি।

মিচেল স্টার্কের করা ৪৯তম ওভারের শেষ বলটি কভারে ঠেলে দিয়ে সিঙ্গেল নিয়ে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন মুশফিক। ৯৫ বলে ৯টি চার ও একটি ছক্কার সাহায্যে বিশ্বকাপে নিজের প্রথম এবং ক্যারিয়ারের সপ্তম সেঞ্চুরিটি তুলে নেন উইকেটরক্ষক-ব্যাটসম্যান। শেষ পর্যন্ত অপরাজিত থাকেন ১০২ রানে।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!