সর্বনাশা ৬০ পণ্যের খোঁজ মিললো চট্টগ্রাম বন্দরে

আরও ৩০ পণ্যের তালিকা বানাচ্ছে চট্টগ্রাম কাস্টমস

চট্টগ্রাম বন্দরে গত ২০ বছর ধরে জমা হওয়া ৬০ ধরনের বিপজ্জনক পণ্য চিহ্নিত করেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস। বন্দরের ‘পি শেডে’ খালাস না নেওয়া এসব পণ্য মজুদ করা রয়েছে। বিপজ্জনক এসব পণ্যের তালিকায় এমন কিছু পণ্য আছে, যা সেই ২০০০ সাল থেকেই শেডে পড়ে আছে। যদি এসব পণ্য বিস্ফোরিত হয়, তাহলে লেবাননের বৈরুতের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে বলে রসায়নবিদরা আশঙ্কা করছেন।

বন্দরের পি-শেডে রাখা বিপজ্জনক পণ্যের তালিকা ঘেঁটে দেখা গেছে, ২০০০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ২০ বছর ধরে সেখানে ৬০ ধরনের বিপজ্জনক পণ্যের মজুদ গড়ে উঠেছে। এসব পণ্যের তালিকায় রয়েছে মেয়াদোত্তীর্ণ হাইড্রোক্লোরাইড, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, বিপজ্জনক কঠিন পদার্থ, বিপজ্জনক উপাদান, রাসায়নিক প্রক্রিয়াকরণের উপাদান, প্রাণঘাতী বিভিন্ন পণ্য।

সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পণ্যের মধ্যে রয়েছে বিপজ্জনক কঠিন পদার্থ, হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড, ব্লাঙ্ককিট, ডাইথোনাইট এবং সালফক্সিলেট, হাইড্রোক্লোরাইড, নাইট্রো গ্লু সলিউশন, কস্টিক সোডা, ফার্মাসিউটিক্যাল উপাদান, বেভারেজ কনসেন্ট্রেট এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ বিভিন্ন রাসায়নিক। তবে এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস অন্তত ৩০টি বিপজ্জনক পণ্যের তালিকা তৈরি করতে পারেনি।

গত ৯ আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) এ বিষয়ে বন্দরের (বন্দর ও সামুদ্রিক) সদস্য সফিউল বারীর নেতৃত্বে ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের কাছে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।

বন্দরের সদস্য (বন্দর ও সামুদ্রিক) এম সফিউল বারী বলেন, ‘পরিদর্শনের সময় আমরা বন্দরের পি-শেডে ২৩ ধরনের পণ্যের মজুদ খুঁজে পেয়েছি। এর মধ্যে আমরা সোডিয়াম কার্বনেট এবং ফুড ফ্লেভারসহ সাতটি আইটেমের একটি বিবরণীও পেয়েছি। এগুলো পরীক্ষার জন্য ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের রাসায়নিক গবেষণাগারে পাঠানো হয়েছে।’

তবে বিপজ্জনক পণ্য চিহ্নিত করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কাস্টমস কর্তৃপক্ষই বন্দরে রাখা পণ্যের বিস্তারিত খুঁজে বের করবে। বন্দর কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব শুধুমাত্র পণ্য সংরক্ষণ করা। সেগুলো ছাড় করা বা নিলাম করা কাস্টমস কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব।’

এদিকে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের রাসায়নিক পরীক্ষক আব্দুল হান্নান নিশ্চিত করেছেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর পি শেডে রাখা সাতটি পণ্যের নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।’

কেমন বিপজ্জনক?
চট্টগ্রামের হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী বলেছেন, বিপজ্জনক কঠিন পদার্থ আগুনের জন্য খুবই বিপজ্জনক। হাইড্রোজেন পারক্সাইডও দাহ্য ও ক্ষতিকর। শরীরের জন্যও এটি ক্ষতিকর। যদি হাইড্রোক্লোরাইডের সঙ্গে পানি মিশে যায়, সেক্ষেত্রে বিস্ফোরণের সম্ভাবনা খুবই বেশি।

দীর্ঘ সময় ধরে কোনো ধরনের রাসায়নিক ও বিপজ্জনক পণ্য সংরক্ষণ করার সুযোগ নেই জানিয়ে ড. ইদ্রিস আলী বলেন, এসব বিপজ্জনক পণ্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তাপমাত্রায় বিভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া দেখায়। এ কারণে বিপজ্জনক এসব পণ্য সংরক্ষণ করার জন্য একটি বিশেষায়িত জায়গা যেমন দরকার, তেমনি সেখানে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ থাকাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন দীর্ঘ সময় ধরে এগুলো মজুদ অবস্থায় পড়ে থাকে, তখন যে কোনো সময় এগুলো পরিবেশ, আবহাওয়া, পানি, বাতাস এমনকি মানুষের জীবনের জন্যও ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে।

রসায়নবিদরা বলছেন, বিশেষ করে নাইট্রেট যৌগ বিস্ফোরক ক্ষমতাসম্পন্ন। অতিরিক্ত তাপ কিংবা কম্পনের কারণে এর বিস্ফোরিত হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। এ কারণে এগুলো যেখানে সংরক্ষণ করা হবে, সেখানে আলো ও বাতাসের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা থাকতে হবে। থাকতে হবে ভেন্টিলেটর ও এসি।

তারা বলেন, জৈব, অজৈব, বিশেষায়িত পদার্থ, ক্যান্সারজনক পদার্থ ও দাহ্য রাসায়নিক আলাদাভাবে রাখা উচিত। মেয়াদোত্তীর্ণ রাসায়নিক পদার্থ নিয়মসম্মতভাবেই বিনষ্ট করার ব্যবস্থা করতে হবে।

রসায়নবিদরা আরও বলেন, রাসায়নিক পদার্থ সংরক্ষণে অবশ্যই পূর্ণ বিবরণীসহ একটি তালিকা রাখা জরুরি। যেসব জায়গায় রাসায়নিক রাখা হচ্ছে, তার তালিকা কম্পিউটার বা নোটবুকে এন্ট্রি থাকতে হবে। এটি সাজাতে হবে বর্ণানুক্রমে। তালিকায় থাকবে রাসায়নিকের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার তারিখ, পরিমাণ, সংরক্ষণের তারিখ এবং বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সেই তালিকা টাঙাতে হবে স্টোররুমে— দৃষ্টিনন্দন স্থানে।

শুধু রাখলেই চলবে না, স্টোররুমকে প্রতিদিনই নজরদারিতে রাখতে হবে। দেখতে হবে আলো-বাতাস-তাপমাত্রা ঠিক আছে কিনা। এসি, ফ্যানসহ ল্যাবের নিরাপত্তা সরঞ্জামগুলো ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা। ওই রুমের তত্ত্বাবধানে যারা থাকবেন, তারা সেখানে ঢুকবেন মাস্ক, অ্যাপ্রোন, নিরাপত্তা চশমা ও গ্লাভস পরে।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!