সম্পদের পাহাড় পদ্মা অয়েল শ্রমিক নেতার, মেয়াদ শেষ উপার্জন অশেষ

পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিতে সভাপতির পদ দখল করে নানা অনিয়মসহ অর্থ লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক ক্যাডার মমতাজুল ইসলাম নামে বির্তকিত এক শ্রমিক নেতার বিরুদ্ধে। তিনি কোম্পানির একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী পদে থেকে নামে বেনামে অর্জন করেছেন কোটি কোটি টাকার সম্পদ— এমন অভিযোগের পরিপ্রক্ষিতে প্রতিবেদকের অনুসন্ধানে বিভিন্ন তথ্য বেরিয়ে আসে।

গত ৪-৫ বছর ধরে সেখানে তিনটি ট্রেড ইউনিয়নের ছয় শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারীকে জিম্মি করে নির্বাচন ছাড়া পদ দখল করে অর্ধকোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগও আছে এই শ্রমিক নেতার বিরুদ্ধে।

মমতাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পদ স্থায়ীভাবে দখলে রাখতে একের পর এক উচ্চ আদালতে রিট ও শ্রম আদালতে মামলা দায়ের করেন। সেসব মামলার কোন রায়ে নির্বাচন স্থগিত রাখতে বলা হয়নি। বরং পরবর্তীতে যারাই এই নির্বাচন দেওয়ার পক্ষে কথা বলছেন তাদের মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়।

এদিকে ২০১৭ সালে ৯ জুলাই পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন দ্বি-বার্ষিক চুক্তিনামায় শ্রমিকদের প্রদেয় বকেয়া থেকে বেআইনিভাবে কোম্পানির নিয়মের অপব্যবহার করে ২৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন মমতাজুল ইসলাম। ২০১৭ সালে ৫ ডিসেম্বর একই নিয়ম অনুসরণ করে ১০ লাখ টাকা তুলে নেন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।

এছাড়া পদ্মা অয়েল কোম্পানিতে সদস্যভূক্ত নয়— এমন কিছু শ্রমিক-কর্মচারী, সিকিউরিটি গার্ড এবং ফায়ার ফাইটার ও সিকিউরিটি গার্ডকে চাকরির খাওয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে ২৫ লাখ টাকা ও কোম্পানির শ্রমিকদের লভ্যাংশ তহবিলের প্রদত্ত ৫ শতাংশ টাকা কৌশলে হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে ৬০০ শ্রমিকের কাছ থেকে প্রায় ৩০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয় বলেও অভিযোগ আছে মমতাজুল ইসলাম ও তার দলের বিরুদ্ধে।

পদ্মা অয়েলের একাধিক কর্মচারী জানিয়েছেন, কোন ধরনের নোটিশ ও মৌখিকভাবে অবগত না করে প্রতিজন শ্রমিকদের থেকে ৬ হাজার টাকা কেটে নেন সিবিএ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। বিষয়টি জানতে পদ্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে গেলে তিনিও সভার সিদ্ধান্তে এই ২৫ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে বলে জানান। দুই বছরের বেশি সময় পার হলেও শ্রমিক-কর্মচারীরা ওই টাকা আর ফেরত পায়নি।

মমতাজুল ইসলামের উত্থান
সূত্র জানায়, পদ্মা অয়েল কোম্পানির সাবেক লেবার ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম। চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পর জামায়াত ইসলামীর মনোনয়ন নিয়ে তিনি চট্টগ্রামের পটিয়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পদপ্রার্থী ছিলেন। এই রফিকুল ইসলামের ছোট ভাই মমতাজুল ইসলাম। তিনিও ছাত্রজীবনে চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজেলের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের ভিপি (সহ-সভাপতি) পদপ্রার্থী ছিলেন। ওই নির্বাচন ইস্যুতে এক ছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনায় আত্মগোপনে চলে যান তিনি। সে সময় পদ্মা অয়েলে বড় ভাইয়ের সহযোগিতায় চতুর্থ শ্রেণির শ্রমিক হিসেবে চেকার পদে নিয়োগ পান মমতাজুল।

নিয়োগে মমতাজুল ইসলামের স্বজনপ্রীতি
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিবিএর সভাপতি পদ টিকিয়ে রাখতে দুই শ্যালককে পদ্মা অয়েলে চাকরি দেন মমতাজুল ইসলাম। এর মধ্যে আবু সাহাদাৎ মো. সায়েম পদ্মা অয়েল সিলেট ডিপোতে অফিস সহকারী হিসেবে কর্মরত। হাফিজুর রহমান নামে আরেক শ্যালক দৌলতপুর ডিপোতে চাকরি করছেন। একইভাবে গুপ্তখাল ব্যারেল ফিলিং পয়েন্ট চাঁদপুর ডিপোতে রিয়াজুল ইসলাম ও মেরাজুল ইসলাম নামে দুই ছেলেকে চাকরি দেন তার বড় ভাই রফিকুল ইসলাম।

মমতাজুল ইসলামের যতো সম্পদ
সিবিএ সাইনবোর্ডের আড়ালের আলিশান চলাফেরা করেন এই কর্মচারী। এক কোটি টাকা মূল্যের প্রিমিও চট্টমেট্রো ১৩-৫২৯০ ও চট্টমেট্রো ১১-৯৪২৭ নম্বরের এলিয়ন গাড়িতে তার চলাফেরা। এর মধ্যে এলিয়ন গাড়ি নাম পরিবর্তনও করেছেন তিনি। খুলশী ও চান্দগাঁও এলাকায় রয়েছে একটি ফ্ল্যাট ও প্লট। বহদ্দারহাট এলাকায় খাজা রোডে তার স্ত্রীর নামে রয়েছে ৮ শতকের একটি প্লট। এছাড়া পটিয়ায় পৈত্রিক জায়গায় নির্মাণ করেছেন প্রায় দুই কোটি টাকা মূল্যের বিলাসবহুল বাড়ি।

নির্বাচনের বিষয়ে পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড এমপ্লয়িজ ইউনিয়নের সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, ‘পদ্মা অয়েল কোম্পানি সিবিএ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে ৬ শতাধিক শ্রমিক কর্মচারী। ২০১৩ সালে সিবিএর নির্বাচন হলেও মেয়াদ শেষ হয় ২০১৫ সালে। শ্রম আইনের ২০২ (১৭) ধারা অনুযায়ী মেয়াদ শেষ হওয়ার ১২০-১৫০ দিন আগে সিবিএ নির্বাচনের জন্য শ্রম পরিচালক বরাবরে আবেদন করার বিধান রয়েছে। দীর্ঘ ২ বছর পেরিয়ে গেলেও তারা ক্ষমতা দখলে নিতে মামলা মোকদ্দমা দিয়ে হয়রানি করেছে প্রতিপক্ষের লোকজনকে। এতে নির্বাচন নিয়ে শ্রমিকদের মাঝে প্রতিনিয়ত ক্ষোভ বাড়ছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদুর রহমান বলেন, ‘পদ্মা কোম্পানির সিবিএর নির্বাচন দিতে ম্যানেজমেন্ট প্রস্তুত রয়েছে। নির্বাচন দিতে আইনগত কোন বাধা নেই। ইতিমধ্যে নির্বাচন বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনে অন্য কোন পক্ষের অনীহা থাকলে সেখানে অথরিটির কী করার আছে?’

অভিযুক্ত মমতাজুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগের বিষয়ে উল্লেখ করলেন তার সবই মিথ্যে। আমাকে বেকায়দায় ফেলতে এসব ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।’

উল্লেখ্য, বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৬ সালে। ২০১৩ সালে সিবিএ নির্বাচনে জয়ী হন মমতাজুল ইসলাম। ২০১৫ সালে ওই কমিটির মেয়াদ শেষ হয়। ২০১৮ সালে পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন ও ১৯৯৮ সালে পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দুটি ট্রেড ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সমর্থিত। তিনটি ট্রেড ইউনিয়নে মোট ৬ শতাধিক শ্রমিক নিয়োজিত রয়েছে।

মুআ/এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!