সমুদ্রে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে, সম্প্রসারণ শেষ অক্টোবরে

আন্তর্জাতিক টার্মিনালের কাজ শেষ হবে আগামী জুনে

কক্সবাজার বিমানবন্দরকে পূর্ণাঙ্গ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপান্তরের কাজ এগিয়ে চলছে দ্রুতগতিতে। সমুদ্রের বুকে রানওয়ে সম্প্রসারণের ৪২ শতাংশ কাজ ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল (যাত্রী প্রান্তিক ভবন) নির্মাণকাজও ৮২ শতাংশ এগিয়েছে। আগামী ২০২৩ সালের অক্টোবরের মধ্যে প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ পুরোপুরি শেষ হবে বলে আশা করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

সমুদ্রে মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ে, সম্প্রসারণ শেষ অক্টোবরে 1

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কক্সবাজার বিমানবন্দর ঘিরে চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। একদিকে চলছে সমুদ্রের বুকে রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজ, অপরদিকে চলছে আন্তর্জাতিক যাত্রী প্রান্তিক ভবন নির্মাণকাজ। সমুদ্র তীরে রক্ষাবাঁধ নির্মাণে ব্যস্ত শ্রমিকরা। চারপাশে রাস্তাও নির্মাণ করা হচ্ছে।

কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক মো. ইউনুস ভুঁইয়া বলেন, সমুদ্র তীরবর্তী জমি পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণ করে সরকার বিমানবন্দটির আরও উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। প্রকল্পের আওতায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রভাব থেকে রানওয়ের সুরক্ষার জন্য সমুদ্র তীরে রক্ষাবাঁধ নির্মাণ এবং বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে চারপাশে রাস্তাও নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পের আওতায় সমুদ্রগর্ভে আরও প্রায় ২২০০ ফুট দৈর্ঘে্যর প্রিসিশন এপ্রোচ লাইট স্থাপনসহ বিদ্যমান রানওয়েতে ক্যাট-২ এজিএল সিস্টেম স্থাপন করা হবে।’

তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ শেষ হলে নতুন ১৭০০ ফুটসহ এই বিমানবন্দরের রানওয়ে হবে ১০ হাজার ৭০০ ফুট। তাই দেশের দীর্ঘতম রানওয়ে সমৃদ্ধ বিমানবন্দর হবে কক্সবাজার। তখন সমুদ্র ছুঁয়ে বি-৭৭৭-৩০০ ইআর, বি-৭৪৭-৪০০ এর মতো বড় আকারের বিমানগুলো এই বিমানবন্দরে অবতরণ করতে পারবে। রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজ আগামী ২০২৩ সালের অক্টোবরের মধ্যেই শেষ করতে চান প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। অপরদিকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে আন্তর্জাতিক যাত্রী প্রান্তিক ভবন নির্মাণকাজও। এ প্রকল্পের আওতায় অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত ১৪ হাজার বর্গমিটারের আন্তর্জাতিক যাত্রী প্রান্তিক ভবন, একটি বোর্ডিং ব্রিজ স্থাপন, ৩৬ হাজার ৩০০ বর্গমিটারের সুপরিসর বিমান পার্কিং ও ১৯০টি অভ্যন্তরীণ/আন্তর্জাতিক যাত্রী এবং ৩৫টি ভিআইপি ভেহিক্যাল পার্কিংবিশিষ্ট কারপার্ক নির্মাণ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে শেষ হয়েছে ৮২ শতাংশ কাজ।’

কক্সবাজার বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক গোলাম মোর্তজা হোসেন বলেন, ‘আমরা বিমানের শিডিউল বৃদ্ধি করেছি। বর্তমানে কক্সবাজার বিমাবন্দরে প্রতিদিন গড়ে ২৫-৩০টি যাত্রীবাহী বিমান ও ৬-৮টি কার্গো বিমান ওঠানামা করছে। রাতে বিমান ওঠানামার জন্যও প্রায় প্রস্তুত। সমুদ্রগর্ভে আরও লাইটিং সিস্টেম স্থাপনের কাজ চলছে।’

পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হলে এই বিমানবন্দর শুধু পর্যটন নয়, যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক বিকাশে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ।

জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আমরা খুবই উজ্জীবিত। রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজটা ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে শেষ হতে যাচ্ছে। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল ২০২৩ সালের জুন মাসে চালু হবে—এমন লক্ষ্য আছে। বিমানবন্দর এবং রেলপথের কাজ যেভাবে এগোচ্ছে, সেভাবে যদি আমরা এগোতে পারি তাহলে কক্সবাজার সত্যিকার অর্থে একটি আন্তর্জাতিকমানের পর্যটন স্থান হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকা শক্তি হিসেবে জিডিপিতেও কক্সবাজার জেলা অবদান রাখবে।’

এদিকে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজে মোট ব্যয় হবে এক হাজার ৫৬৮ কোটি টাকার বেশি। আর আন্তর্জাতিক যাত্রী প্রান্তিক ভবন নির্মাণে ব্যয় হবে ২৭৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।

২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর রানওয়ে সম্প্রসারণ প্রকল্পটির অনুমোদন দেয় সরকার।

বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) জানিয়েছে, দেশের পর্যটন শিল্প বিকাশে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের যাতায়াত সুবিধার জন্য পর্যটননগরী কক্সবাজারের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য প্রধান শহরের মধ্যে যাতায়াত সুবিধা নিশ্চিত করা এবং সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আকাশ পথে দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন করার উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিকমানের বিমানবন্দরে উন্নীত করার লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্প চলমান রয়েছে।

২০১৭ সালের ৬ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রানওয়েতে বোয়িং ৭৩৭-৮০০ জাতীয় বিমান অবতরণের মাধ্যমে ‘কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন (১ম পর্যায়)’ প্রকল্পের আওতায় সিভিল, ন্যাভ-এইড ও এজিএল কাজের উদ্বোধন করেন।

এ প্রকল্পের আওতায় ২৯০ হেক্টর ভূমি বন্দোবস্ত এবং ৮.৩৭ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় বিদ্যমান রানওয়ের দৈর্ঘ্য ৬৭৭৫ ফুট হতে ৯০০০ ফুটে এবং চওড়া ১০০ ফুট হতে ২০০ ফুটে উন্নীত করা হয়। এছাড়াও সুপরিসর বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণের জন্য বিদ্যমান রানওয়ের পিসিএন ১৭ হতে ৯০ এ উন্নীতকরণসহ আইএলএস, ডিডিওআর, ক্যাট-১ এজিএল লাইট স্থাপন, নিরাপত্তা সীমানা প্রাচীর ও ড্রেনেজ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। যাতে ঠিকাদারি কাজের ব্যয় দাঁড়ায় ৬৫৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা।

এরপর ২০২১ সালের ২৯ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমুদ্রগর্ভে আরও ১৭০০ ফুট রানওয়ে বর্ধিতকরণের লক্ষ্যে ‘কক্সবাজার বিমানবন্দরে রানওয়ে সম্প্রসারণ’ প্রকল্প কাজের উদ্বোধন করেন। এ প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়েতে পূর্ণলোডে সুপরিসর বি-৭৭৭-৩০০ ইআর, বি-৭৪৭-৪০০ জাতীয় বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ নিশ্চিত হবে।

প্রকল্পটি সম্পূর্ণ জিওবি অর্থায়নে বাস্তবায়িত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘সিওয়াইডব্লিউইবি-সিসিইসিসি জেভি’ প্রকল্প কাজ বাস্তবায়নে নিয়োজিত রয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় সমুদ্রগর্ভে ৪৩ হেক্টর ভূমি ভরাটের মাধ্যমে ১৭০০ ফুট রানওয়ে বর্ধিত করা হবে যাতে রানওয়ের দৈর্ঘ্য ১০৭০০ ফুটে উন্নীত হবে। এ প্রকল্পের আওতায় সমুদ্রগর্ভে আরও প্রায় ২২০০ ফুট দৈর্ঘ্যের প্রিসিশন এপ্রোচ লাইট স্থাপনসহ রানওয়েতে ক্যাট-২ এজিএল সিস্টেম স্থাপন করা হবে। যাতে সুষ্ঠু ও নিরাপদ বিমান উড্ডয়ন এবং অবতরণ নিশ্চিত হবে।

প্রকল্পের আওতায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের প্রভাব থেকে রানওয়ের সুরক্ষার্থে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের ডিজাইন অনুযায়ী সমুদ্র তীরে রক্ষাবাঁধ নির্মাণসহ বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে অপারেশনাল এলাকার চতুর্পার্শ্বে নিরাপত্তা টহল রাস্তাও নির্মাণ করা হচ্ছে। যাতে সর্বমোট ব্যয় হবে ১৫৬৮৮৫.৫৬ লাখ টাকা। এ প্রকল্প কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে, কাজের বাস্তব অগ্রগতি ৪২.৬৫ শতাংশ। ২০২৩ সালের অক্টোবরের মধ্যে এ প্রকল্প কাজ শেষ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনার জন্য এ বিমানবন্দরে ২৭ হাজার ৭৮৮ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি আন্তর্জাতিক যাত্রী প্রান্তিক ভবন নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে এ প্রকল্প কাজ শেষ হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে এ প্রকল্পের কাজ ৮২ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে।

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!