সভাপতি কাণ্ডে পুড়ছে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রদল, নাটকের পর নাটক

বিএনপি নেতাদের বিরোধের ভার বইছে ছাত্রদল

সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও এলাকায় হামলার শিকার হন দক্ষিণ জেলা ছাত্রদলের সভাপতি শহীদুল আলম শহীদ। ‘মোবাইল চোর’ আখ্যা দিয়ে ছাত্রদলের বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীদের হাতে গণধোলাইয়ের শিকার হন তিনি। কমিটি না দেওয়ার জের ধরে এ হামলার ঘটনা ঘটলেও এটাকে ‘দুস্কৃতিকারী কর্তৃক পরিকল্পিত হামলা’ বলে দাবি করেন শহীদ। অন্যদিকে ত্যাগী নেতাদের কমিটিতে স্থান না দিতে ঘটনাটি ‘পরিকল্পিতভাবে সাজানো নাটক’ বলছেন স্বয়ং কমিটির সাধারণ সম্পাদক।

হামলার পর তিনজন ছাত্রদল নেতাকে অভিযুক্ত করছেন শহীদুল আলম। অভিযুক্ত তিনজনই ছাত্রদলের ‘ত্যাগী নেতা’ হিসাবে পরিচিত। ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নিয়ে ‘ত্যাগী নেতা’দের নামে মিথ্যা অপবাদ ছড়ানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মো. মহসীন।

মো. মহসীন বলেন, ‘ঘটনার পর উনি (শহীদুল আলম) ফেসবুকে লাইভে এসে ঘটনার বিষয়ে বিস্তারিত বলেছেন। সেখানে কোথাও কারও নাম বলেননি, সন্ত্রাসী হামলা বলেছেন। পরে এসে দলের কারও নাম বলে ঘটনাকে রাজনৈতিক রূপ দিলে সেটার জন্য ওনাকে জবাবদিহি করতে হবে। যারা সংগঠনের ত্যাগী কর্মী, সংগঠনে যাদের অনেক অবদান, সবসময় রাজপথে ছিল এমন নেতাদের নাম বলা টেকনিক মনে করছি।’

এদিকে হামলার ঘটনার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে শহীদুল আলম বলেন, ‘যারা করেছে তারা বলতে পারবে কেন করেছে। রিকশা করে আমি যাচ্ছিলাম। ১৫-২০ জন হামলার চেষ্টা চালায়। আমি তিনজনকে চিনেছি। পরিকল্পিতভাবে এরা হামলা চালিয়েছে। হামলাকারীরা দলের কেউ নয়— এরা দুস্কৃতিকারী। দলের কোন কর্মকাণ্ডে এরা নেই। সংগঠনের হলে কোনো অভিযোগ থাকলে সেটা রাজনৈতিক ফ্লোরে তুলবে।’

১৬ বছর পর ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রদলের ৫ জনের একটি কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্র। কমিটি ঘোষণার একমাস পরই দলীয় শৃঙ্খলা পরিপন্থী কাজ করার অভিযোগ এনে সিনিয়র সহ-সভাপতি ইকবাল হায়দার চৌধুরী ও সাংগঠনিক সম্পাদক গাজী মনিরকে অব্যাহতি দেয় কেন্দ্রীয় কমিটি। অব্যাহতি পাওয়া দুজনই রাজনীতিতে জাফরুল ইসলাম চৌধুরী বিরোধী হিসেবে পরিচিত।

সেই কমিটি ঘোষণার আড়াই বছর চললেও এখনও হয়নি পূর্ণাঙ্গ কমিটি। ২ জন অব্যাহতি পাওয়ার পর সভাপতি শহীদুল আলম শহীদ, সাধারণ সম্পাদক মো. মহসীন ও সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক কেএম আব্বাসকে দিয়ে চলছে দক্ষিণ জেলা ছাত্রদলের সাংগঠনিক কার্যক্রম।

অভিযোগ রয়েছে, এই তিনজনের ভিতরেও চলছে অনৈক্য। কমিটি গঠনসহ নানা ইস্যুতে বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছেন তারা। সিনিয়র বিএনপি নেতাদের অনুসারী হিসাবে মাঠে আছেন জেলা ছাত্রদলের সভাপতি-সম্পাদক। বিএনপি নেতাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়েই তাদের এমন বিপরীত অবস্থান বলে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা জানান।

জানা গেছে, দক্ষিণ জেলা বিএনপির সভাপতি জাফরুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক সহ-সভাপতি এনামুল হক এনাম, ইদ্রিস মিয়াসহ বিশাল একটি অংশের সাথে বিরোধপূর্ণ সম্পর্ক চলছে বেশ কিছুদিন ধরে। তাদের বিরোধের জের ছাত্রদলের ওপরও প্রভাব বিস্তার করেছে। আর এই বিরোধকে কাজে লাগিয়ে ছাত্রদল সভাপতি আর্থিক লেনদেনে জড়িয়েছেন— এমন অভিযোগও উঠেছে। প্রতিটি উপজেলার একাধিক নেতার কাছ থেকে আর্থিক লেনদেনে জড়ানোর অভিযোগ আছে শহিদের বিরুদ্ধে। ইতোমধ্যে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গেছে কেন্দ্রেও।

তবে শহীদুল আলম শহীদ বলেন, ‘যারা সাথে ছিল, ত্যাগ করেছে তাদের নাম প্রস্তাব করা কি অনৈতিক? কমিটি সংক্রান্ত লেনদেন করেছি দেখান। জেলার সভাপতি হতে গেলে সবার সাথে সম্পর্ক রাখতে হয়। যিনি অভিযোগ করছেন তার বিরুদ্ধে তো অনেক অভিযোগ। ৬ বছরে কোনো কর্মকাণ্ডে ছিল না, কী করে সেক্রেটারি হলো? রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে না পেরে এখন আমার বিরুদ্ধে সস্তা রাজনীতিতে নেমেছে।’

অন্যদিকে একই বিষয়ে সাধারণ সম্পাদক মো. মহসীন বলেন, ‘সংগঠনকে এগিয়ে নিতে দুজনের একতা দরকার। এখনও আমরা আলাদা কিছু করিনি। মতপার্থক্য থাকতে পারে, কিন্তু সাংগঠনিকভাবে যারা ত্যাগ করেছে তাদের ঘায়েল করার চেষ্টা মেনে নেওয়া যায় না। ব্যক্তিগত সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া অমূলক।’

তিনি আরও বলেন, ‘নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে অন্যের ওপর দোষ চাপানো উচিত নয়। ওনার বিরুদ্ধে অনেকে বিভিন্ন ধরনের লেনদেনের কথা বলেছেন অনেকে। এসএমএসের স্ক্রিনশট দেখিয়েছেন। বিষয়গুলো কেন্দ্রকে অবহিত করা হয়েছে।’

এদিকে দক্ষিণ জেলা ছাত্রদলের প্রস্তাবিত কমিটির একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এখন শহীদুল আলমকে দিয়ে ছাত্রদল ধ্বংস করার জন্য গোপন মিশনে নেমেছেন বিএনপি নেতা। তারই আশ্রয় প্রশ্রয়ে শহীদুল আলম শহীদ দক্ষিণ জেলার নানা ইউনিটে থানা, কলেজ কমিটিতে পদ দেওয়ার নামে আর্থিক লেনদেন করছেন। স্থানীয় বিএনপি নেতাদের পছন্দের লোক আনতে তাদের কাছ থেকেও নিচ্ছেন বড় অংকের টাকা। আর এসব কিছু হচ্ছে সিনিয়র নেতার সম্মতিতে।’

২০১৮ সালের গত ১ আগস্ট চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলার পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট আংশিক কমিটির অনুমোদন দেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাজিব আহসান ও সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান। চট্টগ্রাম কলেজের মাস্টার্সের ছাত্র শহীদুল আলম শহীদকে সভাপতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান মাস্টার্সের ছাত্র মো. মহসিনকে সাধারণ সম্পাদক, ইকবাল হায়দার চৌধুরীকে সিনিয়র সহ-সভাপতি, কেএম আব্বাসকে যুগ্ম সম্পাদক ও গাজী মনিরকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়।

‘ছাত্র’ হিসেবে দাবি করা শহীদুল আলম এখন তিন সন্তানের জনক। বর্তমান কমিটির আগে ২০১১ সালে জসিম উদ্দিনকে আহ্বায়ক এবং মরহুম শহীদুল ইসলামকে সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক করে ১৪ সদস্যবিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি করা হয়েছিল। তারও আগে ২০০২ সালের নভেম্বরে মহসীন চৌধুরী রানাকে সভাপতি ও রেজাউল করিম নেছারকে সাধারণ সম্পাদক করে ৫১ সদস্য বিশিষ্ট দক্ষিণ জেলা ছাত্রদলের পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদন করা হয়েছিল।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!