সতর্কবার্তা পেয়েই মন্ত্রী মুরাদ গভীর রাতে চট্টগ্রাম ছাড়লেন তড়িঘড়ি

১৪ ঘন্টা ছিলেন রেডিসন ব্লুর এক কক্ষে

প্রায় ১৪ ঘন্টা চট্টগ্রামের পাঁচতারকা হোটেল রেডিসন ব্লুতে অবস্থানের পর পদত্যাগের জন্য ‘প্রধানমন্ত্রী আদেশ’ পাওয়া তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান চট্টগ্রাম ছাড়লেন গভীর রাতে। চট্টগ্রামের চেয়ে এই মুহূর্তে ঢাকাই ‘নিরাপদ’ বেশি— সংশ্লিষ্ট মহল থেকে এমন বার্তা পাওয়ার পর মন্ত্রিসভার বিতর্কিত এই সদস্য রাতেই চট্টগ্রাম ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর মঙ্গলবার (৭ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত তিনটার দিকে তিনি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন।

একাধিক সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান রাতটা চট্টগ্রামের পাঁচতারকা হোটেল রেডিসন ব্লুতেই কাটাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহলের পরামর্শে রাতেই ঢাকার উদ্দেশ্যে হোটেল ছাড়তে হয় তাকে। সংশ্লিষ্ট মহল থেকে তাকে বোঝানো হয়, এই মুহূর্তে প্রতিমন্ত্রীর জন্য চট্টগ্রামের চেয়ে ঢাকায় অবস্থান করা বেশি সুবিধাজনক ও নিরাপদ হবে। এরপর রাত তিনটার দিকে সড়কপথেই তিনি ঢাকার পথে যাত্রা করেছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

এর আগে বিতর্কিত মন্তব্য আর কল রেকর্ড ফাঁসের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘অসন্তোষ’ বুঝতে পেরে ঢাকার বাসভবন থেকে সোমবার (৬ ডিসেম্বর) সকালে চট্টগ্রামের পথ ধরেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। দুপুর ২টা থেকে তিনি অবস্থান করছিলেন চট্টগ্রামের স্টেডিয়ামপাড়ার হোটেল রেডিসন ব্লুতে। সেখানকার বিলাসবহুল কক্ষে শুয়ে শুয়েই শুনেছেন মন্ত্রিসভা থেকে অব্যাহতির জন্য ‘প্রধানমন্ত্রীর আদেশ’ পাওয়ার কড়া বার্তা।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, সোমবার (৬ ডিসেম্বর) দুপুরে চট্টগ্রামের রেডিসন ব্লুতে আসেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের বিতর্কিত এই প্রতিমন্ত্রী। সন্ধ্যায় যখন প্রধানমন্ত্রীর আদেশের বিষয়টি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশিত হয়, তখনও ডা. মুরাদ হাসান চট্টগ্রামের রেডিসন ব্লুতেই ছিলেন। ঢাকা থেকে একা এসে রেডিসন ব্লু বে ভিউ হোটেলে উঠেন ডাবল বেডের বিলাসী কক্ষে।

চট্টগ্রামে ডা. মুরাদ হাসানের ঘনিষ্ঠ সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই পুরো সময়ে প্রতিমন্ত্রী মুরাদকে অনেকটাই নির্বিকার দেখা গেছে। চট্টগ্রামে কোনো এক বন্ধুর বাসায় যাওয়ার কথাও ছিল তার।

নির্ভরযোগ্য সূত্রে পাওয়া আরেক খবরে জানা গেছে, রাতে হোটেল রেডিসন ব্লুতে থেকে মঙ্গলবার (৭ ডিসেম্বর) সকালে বন্ধুর বাসায় যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল প্রতিমন্ত্রীর। তবে বিভিন্ন কারণে রাতেই সেখান তাকে সরে যেতে বলা হয় সংশ্লিষ্ট একটি মহল থেকে।

জানা গেছে, চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির সঙ্গে অশালীন কলরেকর্ড ফাঁসের পর সোমবার (৬ ডিসেম্বর) সচিবালয়ে নিজ দপ্তরেও যাননি প্রতিমন্ত্রী মুরাদ। এদিন বিকেল সাড়ে ৩টায় রাজধানীর তোপখানা রোডে অবস্থিত বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদের এক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু সেখানেও যাননি তিনি।

অশালীন ও অতিকথনে সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনার তুঙ্গে থাকা এই প্রতিমন্ত্রী এখন প্রায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। তার মুঠোফোনও বন্ধ।

সোমবার (৬ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের জানান, প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানকে মন্ত্রিসভা থেকে মঙ্গলবারের মধ্যে পদত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের বিষয়টি প্রতিমন্ত্রীকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছেও বলে জানান তিনি।

ওবায়দুল কাদের নিশ্চিত করেই বলেছেন, মঙ্গলবারের মধ্যে মুরাদ হাসানকে পদত্যাগ করতে বলা হয়েছে।

১ ডিসেম্বর রাতে ‘অসুস্থ খালেদা, বিকৃত বিএনপির নেতাকর্মী’ শিরোনামে এক ফেসবুক লাইভে (সরাসরিতে) যুক্ত হন মুরাদ হাসান। ‘নাহি ড্রেইনস’ নামের এক ফেসবুকারের সঙ্গে লাইভের এক পর্যায়ে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কন্যা জাইমা রহমানকে নিয়ে তিনি বিভিন্ন মন্তব্য করেন। এ ছাড়া বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জন্ম ও পরিবার নিয়েও কথা বলেন প্রতিমন্ত্রী। তিনি জাইমা রহমানকে লুইচ্চা বলে অভিহিত করেন। আরও বলেন, ‘প্রতিরাতে কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষের সঙ্গে না শুইলে নাকি তার হয় না।’

একই টকশোতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রোকেয়া হলের ছাত্র নেত্রীদের নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন তিনি। এরপর তার সমালোচনায় মুখর হন বিভিন্ন মহলের লোকজন। এছাড়া তার পদত্যাগেরও দাবি ওঠে। নারীনেত্রীদের পাশাপাশি ছাত্রলীগের মধ্য থেকেও উঠে পদত্যাগের দাবি। তবে এর প্রতিক্রিয়ায় মুরাদ হাসান গণমাধ্যমকে বলেন, তিনি এসব বক্তব্য দিয়ে কোন ভুল করেননি। এগুলো তিনি প্রত্যাহারও করবেন না কিংবা প্রত্যাহার করার ব্যাপারে সরকার ও দলের ওপর থেকে কোন চাপও নেই।

এর মধ্যেই ৬ ডিসেম্বর ডা. মুরাদ হাসানের সাথে ঢাকাই চলচ্চিত্রের নায়িকা মাহিয়া মাহি ও চিত্রনায়ক ইমনের একটি কথোপকথনের কলরেকর্ড ফাঁস হয়। যা ইতোমধ্যে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। অডিও ক্লিপটিতে শোনা যায়, ওই নায়িকাকে তাৎক্ষণিক তার কাছে যেতে বলছেন মুরাদ। নায়িকা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল ও হুমকি দেন প্রতিমন্ত্রী। ওই কথোপকথনে তথ্য প্রতিমন্ত্রী মাহিকে ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সহায়তায় তুলে আনার হুমকি দেন। এমনকি বিকৃত কায়দায় ওই চিত্রনায়িকাকে ধর্ষণের হুমকিও দেওয়া হয় এ সময়। বিষয়টি দেশজুড়ে তীব্র সমালোচনার জন্ম দেয়।

মুরাদ হাসান জামালপুর-৪ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য। তিনি নবম এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ-এর প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালের মন্ত্রীসভায় তিনি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পান। এরপর ২০১৯ সালের ১৯ মে থেকে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।

এআরটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!