সকালে গেলেন নিজে হেঁটে, বিকেলে লাশ— ৪ হাসপাতালে ৫ ঘন্টার যুদ্ধ

শ্বাসকষ্ট নিয়ে দিনভর চেষ্টা করেও পাননি কোন চিকিৎসা। শেষ বিকেলে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মিজানুর রহমানের বদান্যতায় মেলে একটি আইসিইউ সিট। তবুও শেষ রক্ষা হলো না রাঙ্গুনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রব চৌধুরীর (৬৫)। অথচ সকালে নিজে হেঁটে সিএনজিচালিত ট্যাক্সিতে উঠে তারপর গিয়েছিলেন হাসপাতালে। আর শেষ বিকেলে ফিরছেন লাশ হয়ে। মাঝখানে তাকে এবং পরিবারের সদস্যদের মুখোমুখি হতে হয়েছে ৫ ঘন্টার এক দুর্বিসহ এক যুদ্ধের। যে যুদ্ধ চিকিৎসা পাওয়ার যুদ্ধ।

দিনভর তিনটি হাসপাতাল ঘুরে শেষ বিকেলে সেই যুদ্ধে আপাত জয়ী হয়ে জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউ ওয়ার্ডে ভর্তি হতে পারলেও শেষ রক্ষা আর হয়নি আব্দুর রবের। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন রাঙ্গুনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক এই সদস্য।

আব্দুর রব চৌধুরীর পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, গত ২-৩ দিন ধরে হালকা জ্বরে ভুগছিলেন তিনি। ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধও খাচ্ছিলেন। সকালে হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হলে প্রথমে চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান তিনি। সেখানে তার ইসিজি করে বলা হয় তার আইসিইউ সাপোর্ট দরকার। কিন্তু সেখানে আইসিইউ সিট না থাকায় আব্দুর রবকে নিয়ে তার পরিবারের সদস্যরা চলে যান ন্যাশনাল হাসপাতাল। সেখানে প্রথমে রোগীকে ভর্তি নিতে অস্বীকৃতি জানানো হলেও পরে রোগীর স্বজনদের কাতর অনুরোধে তারা ইমার্জেন্সিতে ভর্তি নিতে রাজি হয়। তবে শর্ত জুড়ে দেয় রোগীকে কোন অক্সিজেন দিতে পারবে না তারা। তাদের কাছে কোন অক্সিজেন নেই। রোগীর অক্সিজেন স্যাচুরেশন তখন ৭০ এর কম হলেও পরিবারের পক্ষ থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করে আনার আগ পর্যন্ত ওভাবেই ছিলেন আব্দুর রব।

অথচ একদিন আগে জেলা প্রশাসনের পরিচালিত অভিযানে নিজেদের পর্যন্ত অক্সিজেন বরাদ্দ থাকার কথা জানিয়েছিল ন্যাশনাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। যেটি সংবাদমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে উল্লেখও করেছিলেন হাসপাতালে অভিযান চালানো ম্যাজিস্ট্রেটরা। এই বিষয়ে তাৎক্ষণিকভাবে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদুল ইসলামের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি আব্দুর রবের পরিবারের সদস্যদের সার্ভেইল্যান্স টিমের সাথে যোগাযোগ করতে সহযোগিতা করেন।

এ পর্যায়ে ন্যাশনাল হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়া যাবে না নিশ্চিত হয়ে রোগীর পরিবারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় সার্ভেইল্যান্স টিমের আহ্বায়ক চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানের সাথে। ঘড়ির কাঁটায় তখন আড়াইটা। পরে মিজানুর রহমান ন্যাশনাল হাসপাতালের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে কথা বলেন জিইসি মোড়ের মেডিকেল সেন্টারের সাথে। ন্যাশনাল হাসপাতাল থেকে মেডিকেল সেন্টারে যখন আব্দুর রবকে নিয়ে যাওয়া হয় তখন তার অক্সিজেন স্যাচুরেশন নেমে যায় ৬০ এর নিচে। আইসিইউ না থাকলেও সেখানকার ডাক্তাররা তাকে ভর্তি নেন। অক্সিজেন সাপোর্ট দিয়ে সেখানে কিছুক্ষণ চিকিৎসা দেয়া হয় তাকে।

এর মধ্যে মিজানুর রহমানের প্রচেষ্টায় জেনারেল হাসপাতালে একটা আইসিইউ সিট ম্যানেজ হয় আব্দুর রবের জন্য। বিকেল ৪টার কিছু পরে তাকে সেখানে ভর্তি করা হয়। ঘন্টাখানেক আইসিইউ ওয়ার্ডে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে পরাজিত হন তিনি।

এই বিষয়ে অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মিজানুর রহমান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আড়াইটার দিকে উনার পরিবারের সদস্যরা কল করেছিলেন আমাকে। আমি সাথে সাথে ন্যাশনালের এমডিকে কল দিই। কিন্তু উনাকে পাইনি। জরুরি বিভাগে যে ছিল তিনি আমাকে বলেছেন তাদের ১৩টি সিটে ১৮ জন রোগী আছেন। শেষে আমি মেডিকেল সেন্টারে কথা বলি। তারা রোগী ভর্তি নিতে রাজি হয়। যদিও তাদের আইসিইউ ছিল না। এর মধ্যে জেনারেল হাসপাতাল থেকে আমাকে জানানো হয় একটা আইসিইউ খালি হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে রোগীকে সেখানে পাঠানো হয়। তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করেছে। কিন্তু উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কোনভাবে ৬০ এর ওপর তোলা যায়নি। বিকেলে তিনি মারা যান।’

দিনভর শ্বাসকষ্ট নিয়ে চিকিৎসার জন্য ছোটাছুটি করা আব্দুর রব চৌধুরী রাঙ্গুনিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য ছিলেন। পাশাপাশি ইসলামপুর উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছেন তিন মেয়াদে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার পদে চাকরি করা আব্দুর রব চৌধুরী শেষ সময় নগরীর অক্সিজেন এলাকায় পরিবার নিয়ে বসবাস করছিলেন।

এআরটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!