সংরক্ষিত বনের ঝিরিতে রাতারাতি বাঁধ, পাহাড় কেটে নিজস্ব খাল বানিয়েছে জিপিএইচ ইস্পাত

শুকিয়ে গেছে স্বাভাবিক স্রোতধারা, জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন

‘রাতারাতি অন্তত ২০০ শ্রমিককে কাজে লাগিয়ে বাঁধটি নির্মাণ করেছে জিপিএইচ। তারা বালির বস্তা ফেলে বাঁধটি তৈরি করেছে। এমনকি তারা তাদের ইস্পাত কারখানায় সরাসরি পানি সরবরাহের জন্য একটি পাহাড়ও কেটে ফেলেছে। এই স্রোতধারা শুকিয়ে গেলে সংরক্ষিত বনের বন্যপ্রাণী ছাড়াও নিম্নপ্রবাহে বসবাসরত মানুষদের জীবন চরম হুমকির মধ্যে পড়ে যাবে।’

নতুন কারখানায় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য চট্টগ্রামভিত্তিক জিপিএইচ ইস্পাত লিমিটেড সীতাকুণ্ড উপজেলার জঙ্গল-বাঁশবাড়িয়ার সংরক্ষিত বনের ওপর একটি অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করেছে। বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এর ফলে বনের জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হতে পারে। স্থানীয় গ্রামবাসী পড়তে পারে পানির স্থায়ী সংকটে।

গত ২ এপ্রিল বালির বস্তা ফেলে বাঁধটি তৈরি করা হয়। এর ফলে বনের বিভিন্ন পাহাড় থেকে বয়ে আসা অন্তত সাতটি স্রোতধারা শুকিয়ে গেছে।

৫ এপ্রিল ওই এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় ১০০ মিটার কৃত্রিম খাল খনন করে পানি নিয়ে যাওয়া হয়েছে কারখানার দিকে।

ইস্পাত উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান জিপিএইচ এলাকার কয়েকশত একর জমির মালিক, যার বেশিরভাগই পাহাড়ঘেরা। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, বাঁধটি তৈরি করা হয়েছে অস্থায়ীভাবে। কারণ নির্মীয়মাণ কারখানাটিতে কাজের জন্য পানি সংযোগ নিশ্চিত করা যাচ্ছিল না। অন্তত চার হাজার ২০০ শ্রমিক ওই প্রকল্পে কাজ করছে।

gph-ispat-illegal-stream
বালির বস্তা ফেলে তৈরি করা বাঁধের কারণে বনের বিভিন্ন পাহাড় থেকে বয়ে আসা অন্তত সাতটি স্রোতধারা শুকিয়ে গেছে। ছবি: ডেইলি স্টার

কুমিরা রেঞ্জের ভারপ্রাপ্ত রেঞ্জ কমর্কর্তা গাজী মনিরুজ্জামান বলেন, ‘রাতারাতি অন্তত ২০০ শ্রমিককে কাজে লাগিয়ে বাঁধটি নির্মাণ করেছে জিপিএইচ।’

‌’তারা বালির বস্তা ফেলে বাঁধটি তৈরি করেছে। এমনকি তারা তাদের ইস্পাত কারখানায় সরাসরি পানি সরবরাহের জন্য একটি পাহাড়ও কেটে ফেলেছে। এই স্রোতধারা শুকিয়ে গেলে সংরক্ষিত বনের বন্যপ্রাণী ছাড়াও নিম্নপ্রবাহে বসবাসরত মানুষদের জীবন চরম হুমকির মধ্যে পড়ে যাবে।’ বলেন তিনি।

‘আমরা ইতিমধ্যে জিপিএইচ-এর বিরুদ্ধে সীতাকুণ্ড থানায় একটি মামলা দায়ের করেছি।’

ভারপ্রাপ্ত রেঞ্জ কমর্কর্তা বলেন, ‘এলাকার জাতিগত সংখ্যালঘুরা, বিশেষ করে ত্রিপুরার পল্লী অঞ্চলের মানুষ বাঁধের কারণে পানির তীব্র সংকটে পড়েছে।’ এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য তারা স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বলে জানান তিনি।

ত্রিপুরা পল্লী এলাকার বাসিন্দা, যেখানে প্রায় ২০০ আদিবাসী পরিবারের বসবাস, তারা এ ব্যাপারে মন্তব্য তো নয়ই, এমনকি কথা বলতেও ভয় পাচ্ছিলেন।

চট্টগ্রাম (উত্তর) বিভাগীয় বন কর্মকর্তা বখতেয়ার নূর সিদ্দিকী এ প্রসঙ্গে জানান, এটি নিছক জমি দখলের ঘটনা।

বখতেয়ার নূর সিদ্দিকী বলেন, ‘তারা কয়েকশত শ্রমিককে আটকে রেখে রাতের আঁধারে বাঁধ নির্মাণ করেছে। এমনকি তারা আমাদের কর্মীদেরও হুমকি দিয়েছে যারা সেখানে কাজ বন্ধ করতে গিয়েছিল। বালির বস্তাগুলো সরিয়ে দিয়ে আমরা স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ পুনরুদ্ধারের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।’

সীতাকুণ্ডের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিলটন রায় জানান, ৩ এপ্রিল বনবিভাগের কার্যালয় থেকে একটি অভিযোগ পেয়েছি।

তিনি বলেন, ‘জিপিএইচ এমন কিছু করতে পারবে না যা পানিপ্রবাহ এবং মানুষের জীবন বিপন্ন করতে পারে। তিনি আরো বলেন, আমরা শীঘ্রই এলাকা পরিদর্শন ও জরিপ করবো।’

চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ বদরুল হুদা বলেন, কোম্পানিটি সীতাকুণ্ড উপজেলার কুমিরা এলাকায় ১.২৬ একরবিশিষ্ট পুকুর ভরাট করে তাদের কারখানা সম্প্রসারণ করেছে।

তিনি বলেন, ‘পরিবেশ আদালতের সামনে হাজির হওয়ার জন্য আমরা তাদের একটি নোটিশ দিয়েছি। যেখানে তারা বালির বস্তা ফেলে বাঁধ তৈরি করেছে, পাহাড় কেটে কৃত্রিম পানিপ্রবাহ তৈরি করেছে ওই এলাকা আমরা পরিদর্শন করবো।’

কী বলছে জিপিএইচ ইস্পাত?

জিপিএইচ ইস্পাতের পরিচালক ও অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলমাস শিমুল জানান, তারা পানির বিকল্প উৎস খুঁজে পেতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।

গত সপ্তাহে সীতাকুণ্ডের কুমিরায় জিপিএইচ ইস্পাতের অফিসে এই প্রতিনিধিকে তিনি বলেন, ‘আমাদের নতুন কারখানায় কমপক্ষে চার হাজার ২০০ শ্রমিক রয়েছে, যারা তাদের দৈনন্দিন কাজকর্মের জন্য ২.২ লাখ লিটারের বেশি পানি খরচ করে। জুন মাসে যখন কারখানাটি উৎপাদন শুরু করবে, তখন আমাদের প্রতিদিন ৬০ মিলিয়ন লিটার পানি প্রয়োজন হবে। এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির স্তর খুব গভীরে।’

তিনি বলেন, ভূগর্ভের নিচে তারা অন্তত এক হাজার ফুট খনন করেছেন, কিন্তু পানির সন্ধান পাননি।

“আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডকে একটি স্লুইস গেট ইনস্টল করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। যার ব্যয়ভার আমরাই বহন করবো বলে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছি। প্রস্তাবিত স্লুইস গেটটি পাহাড়ের নিচে পড়া বৃষ্টির পানি পেতে সাহায্য করতো আমাদের। কিন্তু তারা এটি করতে রাজি নয়।

‘অবশেষে চট্টগ্রাম ওয়াসা আমাদের পানি সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রেও অন্তত এক বছর সময় লাগবে। আমরা এক বছর বা এমনকি তারও কম সময়ের জন্য একটি অস্থায়ী কাঠামো হিসাবে বাঁধটি তৈরি করেছি। আমরা এ বছর প্রায় ১০০ হাজার গাছ লাগাব সেখানে।’

তিনি আরও বলেন, কোম্পানিটি ইতিমধ্যে পরিবেশগত সমস্যাগুলো পর্যবেক্ষণের জন্য দুজন পরিবেশ প্রকৌশলী নিয়োগ করেছে যাতে পরিবেশগত কোনও ক্ষতি না হয়।

ডেইলি স্টারে প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভাবানুবাদ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!