ষোলশহর রেলস্টেশনজুড়ে মাদক ও দখলবাজি, যাত্রীদের ভোগান্তি

ট্রেনের অপরিচ্ছন্ন বগি, অরক্ষিত মালামাল, ঠিকাদার লাপাত্তা

চট্টগ্রাম নগরীর ষোলশহর দুই নম্বর গেট রেলস্টেশনটি যেন অপরাধ, মাদকসেবন ও দখলদারদের স্বর্গরাজ্য। দিনদুপুরে চলে জুয়ার আসর ও মাদক কেনাবেচা। সেইসঙ্গে রেলের বিভিন্ন মালামাল পড়ে আছে খোলা আকাশের নিচে। এসব মালামাল নষ্ট হচ্ছে দেখভালের অভাবে, ছিঁটকে চোরের দল চুরি করছে সুযোগ বুঝে। রেললাইন ও স্টেশনের চারপাশ দখল করে গড়ে উঠেছে সারি সারি অবৈধ দোকান। অনেকে আবার রেলের গ্যাস, বিদ্যুৎ অবৈধভাবে ব্যবহারও করছে।

ষোলশহর রেলস্টেশনজুড়ে মাদক ও দখলবাজি, যাত্রীদের ভোগান্তি 1

এই রুটে ২৬টি ট্রেন চলে, যাতে প্রতিদিন প্রায় দু’হাজার মানুষ যাতায়াত করে। কিন্তু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের গাফিলতিতে এসব ট্রেনের প্রতিটি বগি একবারে অপরিচ্ছন্ন। এছাড়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান থেকে পরিষ্কারের জন্য ৩১টি পণ্য সরবরাহের কথা থাকলেও তা শুধুমাত্র কাগজে কলমেই রয়ে গেছে।

ষোলশহর রেলস্টেশনজুড়ে মাদক ও দখলবাজি, যাত্রীদের ভোগান্তি 2

এই স্টেশনের আইনশৃঙ্খলা সামলানোর দায়িত্বে গভর্নমেন্ট রেলওয়ে পুলিশের (জিআরপি) পক্ষ থেকে রয়েছে ১০ জন এবং রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) সদস্য রয়েছে মাত্র ২ জন।

স্টেশনের এসব অনিয়মের সঙ্গে কিছু অসাধু রেল কর্মকর্তা-কর্মচারীর জড়িত রয়েছে। এখান থেকে অবৈধ আয়ের ভাগ তাদের পকেটেও যায় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, চট্টগ্রামের পটিয়া, নাজিরহাট ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রুটের ট্রেন এই ষোলশহর রেল জংশন দিয়ে যাতায়াত করে। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত প্রায় দু’হাজার যাত্রী নিয়মিত যাতায়াত করেন এই স্টেশন দিয়ে। দোহাজারী হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন প্রকল্পেও এই স্টেশনটি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু মাদকসেবন ও বিক্রি, ছিনতাইকারীদের নিরাপদ ঠিকানা এই স্টেশন। এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন নজরদারিও নেই।

রোববার (২৬ মার্চ) ষোলশহর রেলস্টেশনে সরেজমিন গিয়ে দেখা গেছে, স্টেশনের প্রবেশমুখে রাস্তা দখল করে বসেছে ভ্রাম্যমাণ টং দোকান। স্টেশন থেকে রেললাইনে দু’পাশে সারি সারি অবৈধ দোকান দখল করেছে রেলের জায়গা। যাত্রীদের স্টেশনে ঢুকতে-বের হতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। প্লাটফর্মে যাওয়ার ফুটওভার ব্রিজও ভবঘুরেদের দখলে।

এছাড়া প্লাটফর্মের শেষ প্রান্তে দোকানগুলোতে প্রকাশ্যে চলছে জুয়া আসর। অথচ এই প্লাটফর্মের বিপরীত আছে রেলের প্রকৌশল দপ্তরের অধীনে উর্ধ্বতন উপ-সহকারী কর্মকর্তার দপ্তর। সেখানে রেলের কয়েক কোটি টাকার মালামাল পড়ে খোলা আকাশে নিচে। এখান থেকে প্রতি রাতেই মাদকসেবীরা যন্ত্রপাতি চুরি করে বলে জানা গেছে।

প্লাটফর্মে গিয়ে দেখা গেছে, যাত্রী বিশ্রামাগারে ১২-১৪ জন পুরুষ-মহিলা বসে আছেন। তাদের মধ্যে তানিয়া নামের একজন জানান, এই রুটে যাত্রীদের নিরাপত্তা নেই, ওয়াশরুমগুলো নোংরা, নেই পানি। স্টেশনজুড়ে মাদকসেবী, জুয়াড়িদের আস্তানা। এছাড়া প্লাটফর্ম নিচু হওয়ায় ট্রেনে উঠতেও কষ্ট হয়।

ট্রেন পরিচ্ছন্নের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেসরকারি পরিচ্ছন্নকারী প্রতিষ্ঠান ‘জান্নাত ট্রেডিং’ প্লাটফর্ম, ওয়াশরুম পরিষ্কার রাখার দায়িত্ব পেয়েছে। তাদের ক্লিনার নিয়োগ দেওয়ার কথা। কিন্তু স্টেশনে পর্যাপ্ত পরিচ্ছন্নকর্মী নেই। এছাড়া পরিষ্কারের কাজে ৩১টি পণ্য সরবরাহের কথা থাকলেও তা করেনি প্রতিষ্ঠানটি। ছয়জনের বদলে দু’জন লোক দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। পরিষ্কারের মালামাল ঠিকভাবে না দিয়ে স্টেশন মাস্টারের কাছ থেকে কাগজে সব ঠিকঠাক ‘বুঝে পাওয়ার’ স্বাক্ষর নেয় প্রতিষ্ঠানটি।

সহকারী স্টেশন মাস্টার অভি সেন জানান, দিনে ২৬টি ট্রেন এই রুটে চলাচল করে। এতে করে যাতায়াত করে প্রায় দেড় থেকে দু’হাজার মানুষ।

এই স্টেশনে জিআরপি সদস্য রয়েছে ১০ জন। যাদের একজন এসআই, একজন এএসআই এবং আটজন কনস্টেবল। এছাড়া আরএবির একজন করে হাবিলদার ও সিপাহী রয়েছে।

স্টেশনের ইনচার্জ এসআই জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আমাদের ডিউটি প্লাটফর্মে। এর বাইরে আমরা যেতে পারি না।’

আরএনবির হাবিলদার আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘দু’জন সদস্য দিয়ে কী আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব?’

এদিকে ট্রেন পরিষ্কারের দায়িত্বে থাকা ক্লিনার দিদার জানান, তারা দু’জন এই স্টেশন ও ক্যানটনমেন্ট স্টেশনে পালা করে দায়িত্ব পালন করছেন।

ঠিকাদারের কাছ থেকে মালামাল বুঝে নেওয়ার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্টেশন মাস্টার ফখরুল ইসলাম কোনো ধরনের সদুত্তর দিতে পারেননি। তবে তিনি নিয়মিত অফিস উপস্থিত থাকেন বলে দাবি করেন।

স্টেশনের প্লাটফর্ম নিচু প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিভাগীয় প্রকৌশলী (১) আব্দুল হানিফ বলেন, ‘চট্টগ্রাম-দোহাজারীর প্রকল্পের কাজ শুরু হলেই প্লাটফর্ম উঁচুর কাজ শুরু হবে।’

স্টেশনের চারপাশে অবৈধ দখলদারদের বিষয়ে রেলের প্রধান ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী বলেন, ‘কৃষি জমি হিসেবে লিজ নিয়ে অনেকে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করে রেখেছে, যাতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। রমজানের শেষে এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

স্টেশনে জুয়ার আসর ও মাদকসেবীদের উৎপাতের বিষয়ে জানতে চাইলে পাচঁলাইশ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সাদেকুর রহমান বলেন, ‘আমরা কয়েকবার এখানে অভিযান করে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করেছি। এখানে আবারও অভিযান পরিচালনা করা হবে।’

ডিজে

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!