জায়গার দখল নিতেই বারবার আগুন শুলকবহরের কলোনিতে!

র‌্যাংকস এফসির সঙ্গে চুক্তিতে মরিয়া মালিকপক্ষ

চট্টগ্রাম নগরীর শুলকবহরের ডেকোরেশন গলিতে পরিকল্পিতভাবে এক সপ্তাহের ব্যবধানে দুইবার আগুন লাগানো হয়েছে বলে দাবি করছেন ভুক্তভোগীরা। দুই দফা আগুনের শিখায় নিঃস্ব প্রায় ৪ শতাধিক পরিবারের দাবি, সুবিশাল জমির দখল ‘শূন্য’ করতে মালিকপক্ষ প্রতিবারই শুক্রবারকে বেছে নিয়ে দুই দফা আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে দুটি কলোনি। আগুনে পুড়িয়ে দেওয়ার পর ‘হামলার’ নাটক সাজিয়ে ওই কলোনি দুটির বাসিন্দাদের মামলা দিয়ে এলাকাছাড়া করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।

নগর গোয়েন্দা শাখার কর্মকর্তারা জানান, ভিন্ন ভিন্ন সময়ে অভিন্ন কায়দায় আগুন লাগার ঘটনা যথেষ্ট সন্দেহের দৃষ্টিতে রেখেই তদন্তে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

আগুনে পুড়ে ছাই হওয়া ওই কলোনি দুটির বাসিন্দারা জানান, র‌্যাংকস এফসি প্রোপ্রার্টিজ নামের একটি আবাসন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে বহুতল ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কলোনিগুলো থেকে ঘর ছেড়ে যাওয়ার চাপ দিচ্ছিল মালিকপক্ষ। শুলকবহর এলাকার ডেকোরেশন গলিতে সুবিশাল জমি নিয়ে বিরোধ চলে আসছিল একাধিক পক্ষের মধ্যে। এরই মধ্যে শুক্রবার (৩১ জানুয়ারি) পুড়ে ছাই হওয়া কলোনির মালিক হুমায়ূন, শাহনেওয়াজ ও তার ভাইরা মিলে র‌্যাংকস এফসি প্রোপার্টিজের সঙ্গে বহুতল ভবনের চুক্তি করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল। এর জন্য দীর্ঘদিন ধরে ওই কলোনির বাসিন্দাদের ঘর ছাড়তে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল। কিন্তু কম ভাড়ায় থাকতে পেরে জায়গাটি ছেড়ে যেতে চাইছিল না খেটে খাওয়া মানুষগুলো।

এছাড়াও শুক্রবার (৩১ ডিসেম্বর) পুড়ে ছাই হওয়া হুমায়ূন কলোনির জমির সামনের অংশে আবদুল আজিজ নামে অপর এক ব্যক্তির সাথেও দীর্ঘদিনের বিরোধ আছে হুমায়ূনের।

৩১ জানুয়ারি ছাত্তার কলোনির বাসিন্দারা আগুন লাগার বিষয়ে ওই জায়গার শাহ নেওয়াজ বাবুর দিকে আঙ্গুল তুলে আব্দুল আজিজ বলেন, ‘২৪ জানুয়ারি আগুন লাগার পর তিনি কেয়ারটেকারকে বলেছিলেন, হেইটা ধরে নাই (যেগুলো আজ আগুন লেগেছে) এগুলা ধরছে যে (যে কলোনীতে ২৪ জানুয়ারি আগুন লেগেছিল)? কেয়ারটেকার বলতেছে আমি তো বলতে পারি না। এটা বলি চলি গেছে।’

জায়গা নিয়ে মামলা আছে কিনা জানতে চাইলে আব্দুল আজিজ বলেন, ‘আমার মামলা চলতেছে। জায়গটায় আমার নানার বাপ, নানা, মা-বাপ থেকে আমরা আছি। আমাদের তিন পোস্তন (পুরুষ/প্রজন্ম) চলি গেছে। তিন পোস্তনের পর আমি আছি। বিএস-এর মধ্যে আমাদের নাম আছে। পিএস’র মধ্যে আমাদের নাম আছে। আমরা তখন ছোট ছিলাম। এরশাদের আমলে আমার নানা-মামাকে টর্চার করেছে। মামাকে মেরে ফেলেছে। আমাকে নিয়ে গিয়ে বন্দি করে বলেতেছে স্টাম্প দাও। আমি ওকে স্ট্যাম্প দিবো বলি চলি আসছি। আমার সাথে ঝামেলা করায় তিন বছর আগে মহানগর তিন নম্বর আদালতে মামলা করছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘শাহনেওয়াজ বাবুই এখানে আগুন লাগাইছে। এখানে ওখানে দোনোটাতে শাহনেওয়াজ বাবুই জিম্মাদারি। ওইখানে রোডটা হইতে দেয় নাই। সব ভাই মিলে বন্ধ করে দিসে। শাহনেওয়াজ বাবু হচ্ছে শুলকবহর শামসু চেয়ারম্যানের ভাইয়ের ছেলে।’

মমতাজ বেগম নামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘এবার আগুন ধরাই দিসে যে। কী জাতীয় পাউডার আছে যে, পাউডার মারি দিসে যে।’ কে পাউডার মারছে জানতে চাইলে মমতাজ বেগম বলেন, ‘বাবু নেওয়াজ, বাবু নেওয়াজ। এখানে সবাই আমাদের আত্মীয়রা। ওদেরকে উঠাই দেবার জন্য বাবু সাবে ওই সাপ্তায় (সপ্তাহে) ১০টা বাজে, এ সাপ্তায় এখানে আগুন দিসে।

সূক্ষ্ম, কিন্তু নির্মম পরিকল্পনায় পুরো জমি দখলশূন্য করতে শাহনেওয়াজ, হূমায়ুন এবং তার ভাইরা মিলে আগুনে সব পুড়িয়ে দিয়ে জমির পুরো অংশ দখলের পর তা র‌্যাংকস এফসি প্রোপার্টিজের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য ‘পরিকল্পিতভাবে’ পর পর দুই শুক্রবার আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হলো পুরো কলোনি— এমনটি দাবি করেছেন ওই এলাকার অনেক বাসিন্দা।

আগুনে পুড়ে ছাই হওয়া কলোনি দুটির বাসিন্দাদের এমন দাবির প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে জানা যায়, অভিযুক্ত শাহনেওয়াজ সাব্বির গৃহনির্মাণ প্রতিষ্ঠান র‌্যাংকস এফসি প্রোপাটিজ লিমিটেডের ডেপুটি ম্যনেজার পদে নিযুক্ত আছেন।

এদিকে দুই দফা আগুনে সব হারানোর পর শুলকবহর ভরাপুকুর পাড় এলাকায় শাহ নেওয়াজ ও তাদের পারিবারিক বাস ভবনে হামলার হামলার নাটক সাজিয়ে খোলা আকাশের নিচে থাকা বাসিন্দাদের মামলা দিয়ে এলাকাছাড়া করার পরিকল্পনা করছে বলে দাবি করেছে ভুক্তভোগীরা।

হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে ওই পরিবারের সদস্য সাব্বির চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, ‘কে বা কারা হামলা চালিয়েছে তা জানি না।’ তবে পরপর দুই শুক্রবারে আগুন লাগার ঘটনায় ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলেই হঠাৎ ‘ব্যস্ত’ হয়ে উঠেন তিনি। চট্টগ্রাম প্রতিদিনের প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বলেন, ‘আচ্ছা এখন রাখি। আপনার সাথে পরে কথা বলবো।’

যে কলোনি ৩১ জানুয়ারি পুড়লো তার দেখাশোনা করেন মামুনুল ইসলাম হুমায়ুন। তিনি জানান, ‘১৯৯৩ সালে আমার ভাই খাদেমুল ইসলাম মারা যাওয়ার পর বিধবা ভাবীর সংসার চালাতে আমরা এই ঘরগুলো তৈরি করে তাদের চলার একটা পথ করে দিই।’

তিনি বলেন, ‘আমরা উদ্বিগ্ন যে, সেই টাইম। ওইদিন সাড়ে ১০টা, জুমার দিন। আজও কে সেইম সাড়ে ১০টা, জুমা। এটার জন্য আমি চিন্তিত। আমার ভাড়াটিয়াদের সাথে আমাদের সম্পর্ক খুবই ভালো। আজকের বিষয়টা আমার কাছেও সাবোটেজ মনে হচ্ছে। কাউকে দোষারোপ করা ঠিক হবে না।’

মামলা কিংবা শত্রুতা থেকে কেউ আগুন লাগিয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা অসম্ভব কিছুনা। তবে আমি কোন মন্তব্য করবো না, করাটা ঠিক হবে না। জায়গা ডেভেলপ করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওই ধরনের কোন সুযোগ নেই। ওয়াকফ সম্পত্তি এটা। ভোগ করতে পারবেন, নট ফর সেল। ডেভেলপ করতে হলে সেমিপাকা পর্যন্ত করা যাবে, হাইরাইজ করার কোন সুযোগ নেই।’

অভিযোগের বিষয়ে শাহনেওয়াজ বাবুর মুঠোফোনে ফোন করলে তিনি বলেন, আমার বাড়িতে হামলা হয়েছে। আমি থানায় আসছি। পাঁচ মিনিট পর কথা বলবেন বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। এরপর আরো দুই বার ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

‘পরিকল্পিত’ আগুন লাগানোর ঘটনার তথ্য জানতে চেয়ে পাঁচলাইশ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল কাশেম ভুঁইয়ার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, ‘বিষয়টিকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এই গলিতে শুধুমাত্র শুক্রবার আগুনের সূত্রপাতের ঘটনা রহস্যজনক মনে করছে প্রশাসন। বিষয়টি খু্বই অমানবিক।’

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন,‘এই ঘটনায় যদি কেউ জড়িত থাকে তাহলে যতই শক্তিশালী হোক না কেন আইনের আওতায় আসতে হবে।’

এসএস/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!