শীতের চট্টগ্রামে পুরনো দুশমন অ্যাজমার থাবা, বাড়ছে শ্বাসকষ্টের সমস্যা

শীত প্রায় দোরগোড়ায়। সারাদিনে মোটামুটি রোদের তেজ থাকলেও বাতাসে সন্ধ্যার পর থেকেই হিমেল আমেজ। ঋতু পরিবর্তনের সব আয়োজনই শেষের দিকে। আবহাওয়া বদলের অসুখবিসুখে কাবু নগরবাসী। শীত আসার আগে থেকেই ভয় ভীড় করেছে অ্যাজমা রোগীদের মনে। ভাইরাস জ্বর থেকে মুক্তি মিললেও এসব রোগীদের থেকে গেছে শ্বাসটান আর বুকের ব্যাথা।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মা ও শিশু হাসপাতালের মেডিসিন ওয়ার্ড ছাড়াও বিভিন্ন ক্লিনিক ও ডাক্তারদের ব্যক্তিগত চেম্বারে শ্বাসকষ্টে ভোগা অ্যাজমা রোগীদের ভিড় বাড়ছে ক্রমেই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১৩, ১৪ ও ১৬ নং মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসাধীন অ্যাজমা রোগীর সংখ্যা কম নয় এখনই। শুধুমাত্র ১৪ নং ওয়ার্ডেই ভর্তি আছে ২০ জনের বেশি অ্যাজমা রোগী। ১৬ নং ওয়ার্ডে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা অর্ধশতাধিক ছাড়িয়ে গেছে।

বিশেষজ্ঞরা শ্বাসকষ্ট বা অ্যাজমাকে ‘বংশগত অসুখ’ বললেও আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান বলছে, দূষণের জেরে অ্যালার্জির কারণেও এই অসুখে আক্রান্ত হতে পারেন যে কেউ। সাধারণত শীতের শুরুতে ও শীতের সময়ে অ্যাজমা বাড়ে শ্বাসনালীর প্রদাহের ফলে। এই অসুখে ফুসফুসে বাতাস ঢোকার পথগুলো সরু হয়ে ফুলে যায়। মিউকাসও জমতে থাকে সেই পথে। ফলে শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।

মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অসুখে শ্বাস নেওয়ার সময় শাঁ শাঁ করে আওয়াজ হতে থাকে অনেকের। শ্বাসকষ্টের প্রভাবে রাতে না ঘুমোতে পারা, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কাশির দমক বাড়া, ঘন ঘন শ্বাস, সারা শরীরে ঘাম, অল্পেই বুকে কফ জমে যাওয়া, শ্বাস নিতে না পারার দমবন্ধ কষ্ট এই অসুখের প্রধান কয়েকটা লক্ষণ।

তারা আরও বলছেন, তবে কিছু বিষয়ে সচেতন না হলে এই অসুখ যে কোনও সময় বেড়ে যেতে পারে। কুয়াশা, ধোঁয়া, রাসায়নিকের উপস্থিতি, বিশেষ কোনও গন্ধ, গ্যাস, ধুলো ইত্যাদি থেকে অ্যাজমা বাড়তে পারে। যে যে বিষয়ে অ্যালার্জি রয়েছে তাকে অবহেলা করলে অ্যালার্জির প্রভাবে বাড়তে পারে অ্যাজমা। হাওয়ায় ঘুরে বেড়ানো, খালি চোখে দেখতে না পাওয়া, ফুলের রেণু, পশু-পাখির লোম, ঠান্ডা পানীয়, পোকা অনেক কিছু থেকেই এই অসুখ বাড়তে পারে। অ্যালার্জির উৎস জানতে পারলে তাই এই রোগের চিকিৎসা অনেকটা সহজ হয়।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. সূযত পাল চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ইনহেলারই অ্যাজমা রোগীর প্রধান ও প্রথম চিকিৎসা। কিন্তু গ্রামের রোগীরা ইনহেলার ব্যবহারকে শেষ চিকিৎসা বলেই মনে করে। বিশেষত বাচ্চাদের ইনহেলার দিতে অনেকেই ভয় পান।

তিনি বলেন, অ্যাজমা চিকিৎসায় পাঁচটি ধাপ থাকে। অ্যাজমা হচ্ছে ফুসফুসের শ্বাসনালীর প্রদাহ। দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ হয়। এতে করে শ্বাসনালি সরু হয়ে আসে। সংকুচিত হয়ে আসে। শ্বাসকষ্ট হয়। শ্বাসকষ্টের আরো অনেক কারণ রয়েছে। তবে অ্যাজমা হলে শ্বাসকষ্ট হয়।

তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে আমরা প্রথমে রোগীর ইতিহাস নিই। এদের কারও শ্বাসকষ্ট থাকে, কারও কাশি থাকে, কারও বুকে চাপ অনুভব করে, কারও বাঁশির মতো শব্দ হয়। অনেকের আবহাওয়াগত কারণে হয়। অনেকের পরিবারে অ্যাজমার ইতিহাস থাকে। এরপর আমরা কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি। এরপর কিছু ল্যাবরেটরি পরীক্ষা করি।

ডা. সূযত পাল বলেন, আগে ক্লিনিক্যালি ধারণা করি। মূল কাজ হলো ইতিহাসটা নেওয়া। ইতিহাস নেওয়ার পর তার সংবেদনশীল কিছু আছে কি না— এগুলো দেখি। এরপর শারীরিকভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করি। তার শ্বাসনালীতে যে বাতাসপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, সেটা আমরা স্টেথেসস্কোপ দিয়ে বুঝতে পারি। কিছু শারীরিক পরীক্ষা করে বুঝতে পারি। এরপর বুকের একটি এক্স-রে করি। স্পায়োমেট্রি করি। এ ধরনের শ্বাসকষ্টে শ্বাসনালী বন্ধ হচ্ছে, আবার খুলে যাচ্ছে। কারও এমনি খুলে যায়, কারও ওষুধ দিয়ে পরীক্ষা করি।

চট্টগ্রামের এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, অ্যাজমা বা হাঁপানি বাচ্চাদের বেশি হয়। বয়স্কদের হতে পারে। বংশগতভাবে থাকলে হতে পারে। পারিপার্শ্বিকতাও কারণ হিসেবে কাজ করে। পরিবেশগত কারণে বিশেষ কিছু অ্যালার্জি, যেমন—পোলেন, ধুলাবালি, ফুলের রেণু, বাড়িতে কীটপতঙ্গ বা তেলাপোকার বিস্তার। অথবা শখ করে কেউ কুকুর বা বিড়াল পোষেন, এগুলোর পশম। গরু-ছাগলের বিষ্ঠা, খড়কুটো। সংবেদনশীলতা নির্ণয়ের জন্য আমাদের অ্যালার্জি পরীক্ষা রয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা সংবেদনশীলতা বুঝতে পারি।

এ রোগের প্রতিকার ও চিকিৎসা নিয়ে বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বলেন, এটা তো কোনো জীবাণুঘটিত রোগ নয়। এটি হলো দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ। এজন্য এর প্রতিরোধের দিকে আমরা বেশি জোর দিই। নেবুলাইজার দিয়ে তাকে সুস্থ করি। এ ক্ষেত্রে অক্সিজেন লাগে। অক্সিজেন দিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে রক্ষা করি। যে রোগী যে বিষয়ে বেশি সংবেদনশীল, তাকে সেটি থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করি।

তিনি বলেন, চিকিৎসা সম্পর্কে রোগীকে সচেতন করতে হবে যে এটি নিলে রোগীর শ্বাসকষ্ট কমে যাবে। আর ট্যাবলেট ব্যবহারে কষ্ট প্রশমিত হতে একটু সময় লাগবে। আর ইনহেলার যদি আমি সরাসরি শ্বাসনালীতে নিই, তাহলে সমস্যাটা কমে যাবে।

এর ব্যাখা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, প্রথমে রিলিভার হিসেবে নেবুলাইজার সালবিউটামল দিই। যারা স্বল্পমেয়াদি শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসছেন, তাদের অক্সিজেন দিই। এরপর তাকে এক ধরনের ইনজেকশন দিই। দিয়ে প্রদাহটা প্রথমে কমাই। দীর্ঘমেয়াদি আমরা ইনহেলার হিসেবে কর্টিকোস্টেরয়েড জাতীয় ইনহেলার দিই। এছাড়াও ইনহেলারের সঙ্গে কিছু ওষুধ থাকে। প্রদাহের জন্য কিছু রাসায়নিক দায়ী। এ জন্য আমরা মন্টিলুকাস ট্যাবলেট ব্যবহার করি।

ডা. সূযত পাল বলেন, ওষুধের চেয়ে ইনহেলার অনেক বেশি কার্যকর। কেননা ইনহেলারের সাহায্যে ওষুধ নিলে তা সরাসরি শ্বাসনালীতে পৌঁছে যায়। রোগী দ্রুত আরাম পায়। দুই রকম ইনহেলার ব্যবহার করা হয়। রিলিভার অর্থাৎ কাশি ও শ্বাসকষ্ট দ্রুত কমানোর জন্যে ইনহেলার দেওয়া হয়। অ্যাজমার অ্যাটাক চলে যাবার পর আপাতদৃষ্টিতে অসুখটা আর নেই মনে হলেও আবার যে কোনও সময়েই ফিরে আসতে পারে। পুনরায় যাতে অ্যাটাক না হয়, তার জন্যেই প্রিভেন্টিভ ইনহেলার নেওয়া দরকার।

তিনি বলেন, এটি হল ডায়বেটিস বা হাই ব্লাডপ্রেশারের মতো অসুখ, যা সারে না কিন্তু সঠিক চিকিৎসায় নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাই রোগ প্রতিরোধে ট্রিগার ফ্যাক্টরগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। কনকনে ঠান্ডা জল বা ঠান্ডা পানীয় বর্জন করার পাশাপাশি ধূমপান বর্জন করা উচিত। একই সঙ্গে ধোঁয়া, ধুলোসহ সব রকমের অ্যালার্জি প্রতিরোধ করা দরকার।

তবে গ্রামের রোগীদের এ রোগ নিয়ে ভ্রান্ত ধারণার কথা জানালেন ডা. সূযত পাল। তিনি বলেন, গ্রামের রোগীরা প্রথমে অ্যাজমা রোগের চিকিৎসায় হোমিও, আয়রবেদিক, হারবাল ওষুধ খায়। এগুলোতে কোনো কোনো সময় সাময়িক সুস্থ হলে এর ক্ষতিকর প্রভাব দীর্ঘমেয়াদী। পরবর্তীতে খারাপ অবস্থা নিয়ে তারা শহরে এসে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের শরণাপন্ন হয়। ততদিনে রোগী খারাপ অবস্থার দিকে চলে যায়।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষ জয় বলেন, চট্টগ্রামে শীতকালীন প্রকোপ বাড়ায় এ রোগের প্রকোপ বাড়ছে। নতুন রোগী আসছে।

রোগীদের অসেচতনতার কথা উল্লেখ করে এই চিকিৎসক আরও বলেন, সামাজিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে অনেক রোগী এ রোগের কথা মুখ ফোটে বলে না। হাঁপানি শুনে অন্যরা সমালোচনা ও ঘৃণা করবে— এ ভয়ে তারা রোগটিকে গোপন করে। হাতুড়ে ডাক্তারদের কাছে যায়। কবিরাজি ওষুধ খায়।

অনিরুদ্ধ ঘোষ আরও বলেন, অ্যাজমা রোগ প্রতিরোধে ইনহেলারই সবচেয়ে কার্যকর। তাছাড়াও অনান্য যে ওষুধ আছে রোগীরা এসব কিছুদিন খেয়ে ভালো লাগলে আর খায় না। ইনহেলার ওষুধটি শ্বাসনালীর যে অংশে সমস্যা সেটিই আরোগ্য করে। শরীরের অন্য কোনো অংশে এর প্রভাব পড়ে না।

রোগীদের সচেতনতা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, সচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য অ্যাজমা সম্পর্কে সাধারণ জনগণকে জানাতে হবে। জানাতে হবে এজন্য যে, এ রোগের সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা আছে।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৬ নং মেডিসিন ওয়ার্ডের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. তামান্না চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, অ্যাজমা রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ জন রোগী এ সমস্যা নিয়ে এ ওয়ার্ড ভর্তি হচ্ছেন।

রোগীদের অবস্থার কথা বলতে গিয়ে ডা. তামান্না বলেন, অ্যাজমা রোগীদের রোগ নির্ণয় করতে অনেক সময় দেরি করে ফেলা হয়। ভাইরাস জ্বরের পর অনেকেরই ঠান্ডার সমস্যা থেকে রোগটি অ্যাজমার দিকে চলে যায়। রক্তে অ্যালার্জির পরিমাণ বেড়ে যায়। কিন্তু বিশেষজ্ঞ কোনো ডাক্তারকে না দেখিয়ে বাড়ির পাশের দোকান থেকে দিনের পর দিন কাশির ওষুধ খেয়ে যান রোগীরা। কিন্তু এ রোগে সমন্বিত চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। ইনহেলার ব্যবহারের নিয়ম রয়েছে। আর রোগীরা ইনহেলার ব্যবহারকে এ রোগের শেষ পর্যায় মনে করে ভীত হয়ে পড়ে। তাই তারা ইনহেলার ব্যবহারে নিরুৎসাহিত হয়। আমরা প্রথমেই রোগীদের রুটিন টেস্ট করিয়ে নিশ্চিত হই রক্তে অ্যালার্জির পরিমাণ কতটুকু। তারপর রোগীর চিকিৎসা শুরু করি। পূর্ববর্তী চিকিৎসাগুলো পর্যবেক্ষণ করি।

চমেক হাসপাতালের ১৬ নং ওয়ার্ডে রাউজানের জাহেরা বেগমকে পাওয়া গেলো দীর্ঘদিন তিনি অ্যাজমা রোগে ভুগছেন। কিন্তু গ্রাম থেকে শহরে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখিয়েই তিনি নিশ্চিত হয়েছেন তার রোগ সম্পর্কে। সেই ডাক্তারের পরামর্শে তিনি ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছেন। কথা বলতে গিয়ে জাহেরা বেগমের বারবার শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল।

তিনি বলেন, ডাক্তার বলেছে আরও কয়েকদিন থাকতে হবে। মাঝে মাঝেই তার ঠান্ডা লাগতো। জ্বর আসতো। বুকে ব্যাথা করতো। পরে তার শ্বাসকষ্ট দেখা দিল। শাশুড়িকে বললে শাশুড়ি বুকে গরম সেক দিতে বলেন। দিতেনও তিনি। কিন্তু সুস্থ না হয়ে তার শ্বাসকষ্ট আরও বেড়ে যায়। হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়ার পর তার অনেকটা ভালো লাগছে বলে জানান জাহেরা বেগম।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!