শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে পোর্ট সিটি ইউনিভার্সিটিতে নানা কাণ্ড!

দ্বিতীয়কে এড়িয়ে চতুর্থ পেল নিয়োগ

চট্টগ্রামভিত্তিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষক নিয়োগে ঘটছে অবিশ্বাস্য সব কাণ্ড। নিয়োগ পরীক্ষায় যোগ্যতার বিচারে দুজনকে চূড়ান্ত করার পর বিস্ময়করভাবে প্রথম প্রার্থীর পর দ্বিতীয়জনকে এড়িয়ে নিয়োগ দেওয়া হয় চতুর্থ প্রার্থীকে। সেটা নিয়েও চলছে নানা লুকোচুরি।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার খান নোবেল ভালো ফলাফল নিয়ে স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করে কর্মরত আছেন দেশের প্রথম সারির একটি নিউজ পোর্টালে। গত জানুয়ারিতে পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে প্রভাষক পদে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলে সেখানে আবেদন করেন শাহরিয়ার খান নোবেল। ২৮ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৮ জন চাকরিপ্রার্থীর মধ্যে ৫ জনকে মনোনীত করে। এর মধ্য থেকে নিয়োগ দেওয়া হবে দুজনকে। যোগ্যতার বিচারে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন শাহরিয়ার খান নোবেল। কোনো নিয়োগপত্র দেওয়া না হলেও কথা ছিল ১ ফেব্রুয়ারি তিনি যোগ দেবেন বিশ্ববিদ্যালয়ে।

কিন্তু কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার আগেই নোবেল জানতে পারেন, তাকে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে চলছে নানা তালবাহানা। এমনকি তার জায়গায় নিয়োগ দেওয়া হয়ে গেছে অন্য আরেকজনকে। অথচ এখনও পর্যন্ত নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে তাকে খোলাসা করে কিছুই জানায়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বারবার সময় চেয়ে ‘জানাচ্ছি, জানাবো’ বলেই ঝুলিয়ে রেখেছেন নোবেলের নিয়োগ।

জানা গেছে, পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক পদের বিপরীতে যে পাঁচজনকে মনোনীত করা হয়, তাদের মধ্যে প্রথম অবস্থানে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী। দ্বিতীয় অবস্থানে শাহরিয়ার খান নোবেল। তৃতীয় অবস্থানে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের এক শিক্ষার্থী। চতুর্থ অবস্থানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন এবং পঞ্চম অবস্থানে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী। পরবর্তীতে প্রভাষক পদে চূড়ান্ত করে প্রথম দুজনকে। বিস্ময়করভাবে প্রথম প্রার্থীর পর এদের মধ্যে নিয়োগ দেওয়া হয় তালিকায় থাকা চতুর্থ প্রার্থীকে।

এ প্রসঙ্গে শাহরিয়ার খান নোবেল বিস্তারিত উল্লেখ করে বলেন, ‘আমাদের যখন ভাইভা শেষ হয় আমাদের পাঁচজনকে ভিসি স্যারের রুমে ডাকা হয়। এরপর স্যার নিজেই পড়ে শোনান আমাদের মধ্যে কে কোন্ অবস্থানে আছেন। তখন সবার সামনেই আলোচনা হয় জয়েনিংয়ের প্রসেস, কী কী দায়িত্ব পালন করতে হয়— এসব বিষয় নিয়ে। পরে স্যার বলেন যে আমাদের খুব আর্জেন্ট টিচার লাগবে, আমরা দুজনকে নেবো। আমাদের কালকে থেকেই দরকার। আপনাদের মধ্যে কে কে কালকে জয়েন করতে পারবেন? পরে যিনি প্রথম হয়েছেন তিনি বলেছেন পারবেন। আমি জানিয়েছি যে, আমি অলরেডি একটা জায়গায় আছি, সেখান থেকে ছেড়ে আসতে সময় লাগবে। পরেরজনও একই কথা বলেছেন। তবে শেষের দুজন বলেছেন তারা কালই জয়েন করতে পারবেন। পরবর্তীতে আবার আমাকে ডাকে এবং সে সময় এক তারিখেই জয়েন করার কথা কনফার্ম করা হয়। এরপর আমি ঢাকায় ফেরার পথে বাসে বসে আমার অফিসকে জানাই চাকরি ছাড়ার কথা। আর আমি এক তারিখে জয়েন করছি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে।’

নোবেল বলেন, ‘পরদিন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার জাকির সাহেবকে ফোন করি। তখন তিনি আমাকে জানান ট্রাস্টি বোর্ডের মিটিংয়ের পর আমাকে কনফার্ম করবেন। এরপর বারবার সময় চেয়ে আমাকে জানাচ্ছি-জানাবো বলে অপেক্ষায় রেখেছেন। এক ফেব্রুয়ারি জয়েন করার কথা বলে কর্তৃপক্ষ আমাকে এখনো পর্যন্ত হ্যাঁ কিংবা না— এর কোনোটাই বলেননি। পরে জানলাম প্রথমজন এবং যিনি চতুর্থ হয়েছেন তিনি জয়েন করেছেন।’

নিজের হতাশা জানিয়ে শাহরিয়ার খান নোবেল বলেন, ‘এটা আমার লাস্ট ডেস্টিনেশন না। এমন না যে আমার যোগ্যতা নেই বা এখানে চাকরি না হলে আমার অন্য কোথাও চাকরি হবে না। কিন্তু এ ঘটনায় আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। এভাবে ঝুলিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত আমার মনোবলকে ভেঙে দিয়েছে।’

এদিকে, অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ে দেখা যায় প্রার্থীর সঙ্গে এ বিষয়ে মোবাইলে ছয়বার কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্টার মো. জাকির হোসাইনের। এর মধ্যে ২৯ জানুয়ারি তিনবার, ৩০ জানুয়ারি দুইবার এবং সর্বশেষ ২ ফেব্রুয়ারি একবার কথা হয়। প্রত্যেকবারই ‘জানাবো, জানাচ্ছি’ বলে অপেক্ষায় রেখেছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে ৩০ জানুয়ারি সন্ধ্যা ৭টা ৩২ মিনিটে ফোন করে আগামীকাল (৩১ জানুয়ারি) বোর্ড মিটিংয়ের পর ১১টার ভেতর চূড়ান্তভাবে জানানো হবে বলে কথা দেন রেজিস্ট্রার। কিন্তু এরপর থেকে এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অপেক্ষায় রেখেছেন নোবেলকে।

এ বিষয়ে পোর্ট সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ফার্স্ট-সেকেন্ড থার্ডের যে বিষয়টা সেটা মৌখিকভাবে বলা হয়েছে। সেটার লিখিত কোনো ডকুমেন্টস নাই। প্রার্থীরাও দেখাতে পারবে না। ফলে কর্তৃপক্ষ যাকে ইচ্ছে তাকে নেওয়ার এখতিয়ার রাখে। এখানে অন্য কারও হস্তক্ষেপের সুযোগ নাই। তবে এটাও ঠিক যে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছেলেটার সঙ্গে যে কাজটা করেছে সেটা ভালো করেনি। তাকে না নিলে নিষেধ করে দেওয়ার দরকার ছিল। কিন্তু তাকে চাকরিতে যোগদানের টাইমটেবিল ফিক্সড করে, আশ্বাস দিয়ে পরবর্তীতে তা না করে ঝুলিয়ে রাখা সেটা ভালো হয়নি। কিন্তু এসব বিষয়ে আমাদের বলার কিছু নেই।’

২০২১ সালে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক নিয়োগে অভিন্ন নিয়োগ নির্দেশিকা প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। সেই নির্দেশিকায় প্রার্থীদের ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মেধা যাচাইয়ের জন্য লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থীদের সংক্ষিপ্ত তালিকা করে সেখান থেকে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রার্থী নির্বাচন করে শিক্ষক নিয়োগ দেবে। এর বাইরে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার যে রীতি-রেওয়াজ বর্তমানে চালু রয়েছে, তা রহিত করার নির্দেশনাও দেওয়া হয়। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চাকরির সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। যে কারণে শুধু সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এবং ট্রাস্টি বোর্ডের অধীনে সব ধরনের নিয়োগ হয়ে থাকে। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো নীতিমালা না থাকায় কোনো ধরনের নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করে না ওই বোর্ড।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান কাজী আনিস এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একজন চাকরি প্রার্থীকে জয়েন করার কথা বলে পরে উল্টে যাওয়া। জানাচ্ছি-জানাবো বলে তাকে ঝুলিয়ে রাখা, এমনকি তার জায়গায় অন্য আরেকজনকে যিনি কিনা চতুর্থ হয়েছেন তাকে নিয়োগ দেওয়া; এমন ঘটনা আমার পেশাগত জীবনের কোনো নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দেখিনি। এ ঘটনায় তার পেশাগত জায়গায় একটা অনিশ্চয়তা এবং অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে। এমনকি কর্মস্থলে তার পেশাগত মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়েছে। আমি মনে করি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এ ধরনের ঘটনা একটি ন্যাক্কারজনক ঘটনার উদাহরণ হয়ে থাকবে।’

এ ব্যাপারে পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য মো. নুরুল আনোয়ার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পাঁচজনের প্যানেল থেকে যে দুইজন ভালো তাদেরকে নেওয়া হয়েছে। এখানে কী আসে যায়, কিছুই তো করার নাই। এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কিছু নাই। এটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের প্যানেলে থাকলে প্রয়োজন হলে ওই ছেলেকে (শাহরিয়ার খান নোবেল) যেকোনো সময় ডাকতাম। এখন সেখান থেকেও বঞ্চিত হইল।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্টার মো. জাকির হোসাইনকে ফোন করা হলে তিনি ব্যস্ততার কারণ দেখিয়ে কথা বলতে চাননি।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!