শিক্ষকের দেখাদেখি শিক্ষার্থীও সিগারেটে ঝুঁকছে চট্টগ্রামের স্কুল-কলেজে

‘ধূমপান মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়’, ‘ধূমপানে ক্যান্সার হয়’— এ জাতীয় সতর্কতা বাক্যের ব্যবহার কেবল কাগজ-কলম আর সভা সেমিনারের ব্যানারেই সীমাবদ্ধ। ধনুষ্টংকারের প্রভাবে যেমন সন্তান বিকলাঙ্গ হয়, ঠিক তেমনি মাদকের প্রভাবে পুরো প্রজন্ম বিপথে চলে যেতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের সিগারেট আসক্তির বিষয়ে ইয়ং পাওয়ার ইন সোশ্যাল অ্যাকশন (ইপসা) পরিচালিত এক জরিপে এমনই এক চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে।

চট্টগ্রাম নগরীর ১০০ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘিত হচ্ছে। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ‘৪১ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধূমপান হচ্ছে’।

উল্লেখ্য, একই জরিপে শতভাগ গণপরিবহনে এই আইন লঙ্ঘনের তথ্য উঠে এসেছে। একই সাথে নগরীর ৯৯ শতাংশ সরকারি অফিস এবং রেস্টুরেন্টে ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন’ মানা হচ্ছে না। ৫৪ শতাংশ সরকারি অফিস ও ৫০ শতাংশ রেস্টুরেন্টে ধূমপান হচ্ছে।

শিক্ষকের দেখাদেখি শিক্ষার্থীও সিগারেটে ঝুঁকছে চট্টগ্রামের স্কুল-কলেজে 1

বাদ যায়নি স্বাস্থ্যকেন্দ্রও। নগরীর ৯৭ শতাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মানা হচ্ছে না আইন। মোট ১ হাজার ৪৩৫ টি পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহন থেকে এ তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ২৮২টি সরকারি অফিস, ১৮৭ টি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র, ১২৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৪২৩টি রেস্টুরেন্ট,এবং ৪১৯টি গণপরিবহনে এ জরিপ চালানো হয়।

চট্টগ্রাম নগরীর ৪১টি ওয়ার্ডের ১২৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলতি বছরের জুন থেকে ৩ মাসব্যাপী ইপসার মাঠ পর্যায়ের পরিচালিত জরিপে এ সংক্রান্ত তথ্য উঠে আসে। প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানে গড়ে ২৫-৪০ মিনিট পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করা হয়।

ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনের (সংশোধিত ২০১৩) ৪ ধারা অনুসারে উন্মুক্ত স্থান ও উন্মুক্ত পরিবহনে ধূমপান নিষিদ্ধ। আইনের ৮ ধারা অনুযায়ী সকল পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহনে সতর্কতামূলক নোটিশ প্রদর্শন বাধ্যতামূলক এবং আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী যে কোনো উপায়ে তামাকজাত দ্রব্যের সকল ধরনের বিজ্ঞাপন, প্রচার-প্রচারণা ও প্রণোদনা নিষিদ্ধ। উন্মুক্ত স্থানের সাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও অন্তর্ভুক্ত।

অথচ জরিপে দেখা গেলো, ১০০ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে উল্লেখিত সর্তকতামূলক নোটিশ পাওয়া যায়নি। ৮৩ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোন ধরনেরই সতর্কতামূলক নোটিশ পাওয়া যায়নি। এছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরাসরি ধূমপান করতে দেখা গেছে ১৯.২ শতাংশকে। সিগারেটের অংশবিশেষ পাওয়া গেছে ৩৬ শতাংশ এবং ছাইদানি পাওয়া গেছে ৩.২ শতাংশ। ২২ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানের পিকও দেখা গেছে।

চট্টগ্রাম নগরীর শতভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সতর্কতামূলক বার্তা না থাকা প্রসঙ্গে শিক্ষা বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রফেসর আবদুল আলীম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সপ্তাহখানেক আগে এই নিয়ে একটা মিটিং হয়েছিল। সেখানে শিক্ষাবোর্ডের একজন প্রতিনিধিও পাঠানো হয়েছে। এটার জন্য সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয় আছে। আমরা তো মূলত পরীক্ষার বিষয়গুলো দেখি। এখন এই বিষয়টা যেহেতু আমাদের নলেজে আসছে, আমরা আমাদের কনসার্ন যারা তাদের সাথে কথা বলবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘সচেতনতার ডেভেলপমেন্টের জন্য আসলে আইন লাগে না। এটার জন্য আন্তরিকতা যথেষ্ট। যেহেতু আমাদের সাথে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ হয় তখন এই বিষয়ে পরিসংখ্যান তুলে ধরবো যাতে করে এটা থেকে বের হওয়া যায়।’

একই প্রসঙ্গে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মো. আবু হাসান সিদ্দিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘যে কোনো গবেষণা বা তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের একটা পজেটিভ দিক আছে। এখন তাদের রিপোর্টটা আমাকে পেতে হবে, তারা রিপোর্টে কি বলেছে সেটাও জানতে হবে। মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের সাথে এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্র বা নির্দেশনার সবকিছু একসাথে কম্পাইলেশন করে পজিটিভ কিছু করণীয় থাকে তা করা হবে। অবশ্যই ভালো কিছু করণীয় আছে এবং কিছু একটা উদ্যোগ নেয়া হবে। এর প্রেক্ষিতে যা যা করা প্রয়োজন তা অবশ্যই করা হবে।’

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরাসরি ধূমপান প্রসঙ্গে সাহিত্যিক শিক্ষাবিদ সাবেক অধ্যক্ষ ড. আনোয়ারা আলম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘জরিপের ফলাফলটি আমার কাছে দুঃখজনক। যেখানে নৈতিকতা শিক্ষা দেবে সেখানে শিক্ষকরেই যদি ধূমপান করে তাহলে এটা অবশ্যই শিক্ষকতা পেশার রুলস লঙ্ঘন করা হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা যদি ধূমপান করে এটা তাদের জন্যও নৈতিকতা বিরোধী। এছাড়া ধূমপান যে নিষিদ্ধ এটা আমাদের বাচ্চাদের শেখানোর দায়-দায়িত্ব আমাদেরই।’

তিনি আরও বলেন, ‘ধূমপান এক ধরনের নেশা। ধূমপানের আসক্তির মাধ্যমেই পরে মাদক আসক্তির জন্ম নেয়। আর নেশা জাতীয় দ্রব্য থেকে দূরে থাকার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেরই দায়িত্ব। আমার মতে যারা প্রকাশ্যে ধূমপান করছে তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করছে। এই আসক্তি থেকে দূরে থাকা উচিত সে বিষয়ে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ না করা মানেই হলো শিক্ষকরা তাদের দায়িত্ব পালন করছেন না। এটি আমাদের জন্য অশনি সংকেত।’

এ প্রসঙ্গে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপ-পরিচালক শামীম আহমেদ বলেন, ‘আমরা এই বিষয়ে সবসময়ই কাজ করে যাচ্ছি। আইন অনুযায়ী যে অপরাধ করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

প্রসঙ্গত,শনিবার (১৪ ডিসেম্বর) নগরীর প্রেসক্লাবের এস রহমান হলে সংবাদ সম্মেলনে ‘চট্টগ্রাম শহরে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রতিপালনের অবস্থা’ শীর্ষক জরিপের এই প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইপসা। এতে লিখিত বক্তব্য পড়েন ইপসার উপ-পরিচালক নাছিম বানু।

সংবাদ সম্মেলনে ইপসার প্রধান নির্বাহী মো. আরিফুর রহমান বলেন, ‘২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। তবে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষিত না হলে এই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে না। দেশে তামাক ব্যবহারের কারণে প্রতি বছর ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ তাই এখন সময়ের দাবি।’

এসআর/এসএস

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!