শিক্ষকদের এক মাসের বেতনে হবে অডিটরের ‘ঘুষ’

শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অডিট করেছেন এক অডিটর। অডিটের ফলাফল পজিটিভ করতে অডিটরকে দেওয়া হবে ঘুষ। আর এজন্য শিক্ষক-কর্মচারীদের এক মাসের বেতন নিয়ে নিলেন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। যার পরিমাণ ৪ লাখ টাকার কিছু বেশি।

এমনই এক অভিযোগ এসেছে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার এক মাদ্রাসা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। অধ্যক্ষের নাম মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস। তিনি সন্দ্বীপের বশিরিয়া আহমদিয়া আলহাজ্ব আবু বকর সিদ্দীক ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। এই অভিযোগ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে রয়েছে অভিযোগের পাহাড়। মাদ্রাসার ২৩ জন শিক্ষক-কর্মচারী থেকে তিনি এই টাকা আদায় করেছেন।

মাদ্রাসার ৪ জন শিক্ষক ও একজন কর্মচারী একমাসের বেতন নেওয়ার বিষয়টি চট্টগ্রাম প্রতিদিনের কাছে নিশ্চিত করেছেন।

তারা বলেন, গত ১৩ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের মাদ্রাসা অডিট করতে আসেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক আব্দুল্লাহ আল মামুন। ১১-১৫ মার্চ পাঁচদিন ধরে অডিট করার কথা ছিল। তবে তিনি শুক্রবার এসে একঘন্টায় অডিট করে চলে যান। পরবর্তীতে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আমাদের জানান, অডিটের ফলাফল পজিটিভ করতে আমরা মামুন সাহেবকে এক মাসের বেতন দেবো। না হলে আমরা ব্যক্তি পর্যায়ে তো বটেই, মাদ্রাসাও এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ নিয়ে তিনি গত ২০ জুন (শনিবার) মাদ্রাসায় শিক্ষকদের নিয়ে বৈঠকও করেন।

ওই শিক্ষকরা আরও জানান, লকডাউনের মধ্যে আমরা এমনিতে কষ্টে আছি। এর মধ্যে এক মাসের বেতন দিয়ে দেওয়ায় আমাদের কষ্ট আরও বেড়ে গেল।

এদিকে মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ছাড়াও আরো বেশ কিছু অভিযোগ উঠেছে। পাবলিক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের নকল সরবরাহ করা, মাদ্রাসার জমি বিক্রি করা, বিদেশ থেকে আসা বিভিন্ন অনুদান আত্মসাৎ, শিক্ষকদের মানসিক টর্চার করে চাকরি থেকে অব্যাহতি নিতে বাধ্য করাসহ বিভিন্ন ধরনের অনৈতিক কর্মকান্ডের অভিযোগ রয়েছে।

জানা যায়, সন্দ্বীপে মাদ্রাসার জন্য পাবলিক পরীক্ষার কেন্দ্র একমাত্র এই মাদ্রাসা। ফলে এতে অন্য মাদ্রাসার সাথে বশিরিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও পরীক্ষা দেয়। আর এই সুযোগে অধ্যক্ষ ইলিয়াস নিজের শিক্ষার্থীদের নকল সাপ্লাই দেন বলে অভিযোগ আছে। গত বছর অনুষ্ঠিত হওয়া আলিম (উচ্চ মাধ্যমিক) পরীক্ষায় নকল সাপ্লাইয়ের প্রতিবাদ করায় অন্য এক মাদ্রাসার প্রভাষককে জুতাও মারেন তিনি। এছাড়া পাবলিক পরীক্ষার পর অতিরিক্ত যে খাতা থেকে যায়, তা বোর্ডে জমা না দিয়ে অভ্যন্তরীণ পরীক্ষায় ব্যবহার করেন।

তার অত্যাচার ও মানসিক নির্যাতনের ফলে মাদ্রাসা থেকে অন্তত ৯ জন শিক্ষক-কর্মচারী অব্যহতি নিয়ে চাকরি ছাড়েন। এর মধ্যে সর্বশেষ আকতার নামে পৌরনীতির এক প্রভাষকের বেতন বন্ধ রেখে তাকে মানসিকভাবে টর্চার করেন। একপর্যায়ে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন।

এছাড়া ১৯৯০ সালে কুয়েত সরকারের ওয়াকফ মন্ত্রণালয় থেকে মাদ্রাসার নতুন ভবন নির্মাণ করার জন্য ২ লাখ ১৮ হাজার টাকা পাঠানো হয়। যার পুরোটাই তিনি আত্মসাৎ করেন বলে ১৯৯২ সালে গর্ভনিং বডির কাছে লিখিত অভিযোগ করেন খোদ তৎকালীন মাদ্রাসার উপাধ্যক্ষ মাওলানা জামাল উদ্দীনসহ একাধিক শিক্ষক।

১৯৯১ সালে জলোচ্ছ্বাসে ক্ষতিগ্রস্থ মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠানো কাতার সরকারের কাপড়ের গাঁইট তিনি ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ছাড়িয়ে নগরীর হালিশহরে নিজের বাড়িতে রেখে দেন বলেও গভর্নিং বডির কাছে লিখিত অভিযোগ করেন মাদ্রাসার তৎকালীন উপাধ্যক্ষ।

এদিকে মাদ্রাসার ১.৫০ একর জমি বিক্রি করার পর অন্যত্র জমি কিনবেন বলে জানালেও আর জমি কিনেননি তিনি।

এছাড়াও তার এসব অনিয়ম অনৈতিক বিষয়ে মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের কেউ প্রতিবাদ করলে তিনি কথায় কথায় চাকরিচ্যূত করবেন বলে হুমকি দেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াস সব অভিযোগ অস্বীকার করে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিষয়টা হচ্ছে তিনি ৯টি স্কুল আর একটা মাদ্রাসা জরিপে এসেছেন। এর মধ্যে আমাদেরটা অনলাইন জরিপ হয়েছে। অনলাইনে আমরা সব কাজকর্ম সম্পন্ন করেছি। যার যার সমস্যার বিষয় সে সে ফেইস করবে। এটা হলো মৌলিক কথা। আমাদের এই মিনিস্ট্রি অডিটে প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শুরু করে যাবতীয় সব কাগজপত্র ওনারা দেখেন। ওনারা ইচ্ছা করলে যেকোন সময় প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করতে পারেন। যেমন আমার সার্টিফিকেট, অ্যাপয়েন্টমেন্ট থেকে শুরু করে যেকোন সময় যেকোন কিছু ভূয়া রিপোর্ট দিয়ে প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারেন। ওনাদের হাতের মধ্যে এই ক্ষমতাটা আছে। যার ফলে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আমরা ওনাদের সাথে আচরণগত দিক থেকে যতটুকু সিমপ্যাথি পাওয়ার চেষ্টা করি। এর বাইরে অন্য কিছু না।’

তিনি আরও বলেন, ‘এমপিওভুক্তির সময় আমাদের টাকা দিতে হয়। এটার কোনো প্রমাণ নাই। এখানেও যেরকম মিনিস্ট্রি অডিটের সময় বিভিন্ন প্রশ্ন করে, বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন করে, সেগুলো প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, ব্যক্তি-ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ফেইস করে। এগুলোর কোনো প্রমাণ নাই।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি কোনো পয়সা নিই নাই। যার যার সমস্যা সে সে সমাধান করার চেষ্টা করেছে।’

অন্য অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার মাদ্রাসা পরিচালনা কমিটি আছে। কারও অভিযোগ থাকলে তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!