শান্ত সাগরে মানুষ পাচার, রোহিঙ্গারাই টার্গেট

শীত এলেই উত্তাল সমুদ্র কিছুটা শান্ত থাকে। সমুদ্রের এই শান্ত রূপকে ব্যবহার করে সক্রিয় হয়ে উঠে মানবপাচারকারী চক্র। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষই থাকে এই চক্রের শিকার। তবে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকেই অভিনব কৌশলে ফের সক্রিয় হয়ে উঠে মানবপাচারকারী চক্র। এখন তাদের মূল টার্গেট রোহিঙ্গারা। এই চক্র বাস্তুহারা রোহিঙ্গাদের সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে পাচার করে চলেছে। যদিও মাঝেমধ্যে পাচারের শিকার মানুষদের উদ্ধার করা সম্ভব হলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় মূল সিন্ডিকেট চক্রের হোতারা।

জানা যায়, চক্রটি প্রথমে দালালদের মাধ্যমে রোহিঙ্গা যুবক ও তরুণীদের নানা ধরণের প্রলোভন দেখিয়ে উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে বের করে এনে সুবিধাজনক জায়গায় জড়ো করে ট্রলারে কিংবা নৌকা করে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে পাচারের কাজটি শুরু করে। তবে সংশ্লিষ্টদের মতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথাযথ নজরদারির অভাবে সীমান্তে ফের মানবপাচারকারী চক্র জেগে উঠেছে। এর আগে এটি প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। প্রতারণার শিকার হয়ে জীবিকার উদ্দেশ্যে অবৈধ পথে সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে মাঝ দরিয়ায় ট্রলার ভর্তি হাজারো মানুষের আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস। পাচারকারীদের নির্মমতার শিকার হয়ে মৃত্যুর ঘটনাও শোনা যায় প্রায়ই।

পুলিশের তথ্য মতে, গত ১০ মাসে সমুদ্রপথে ট্রলারে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় প্রায় ৬০০ জনকে উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। যাদের সবাই বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা। এদের মধ্যে পুরুষদের পাশাপাশি রোহিঙ্গা নারী-শিশুও ছিল। গত দুই মাসে প্রায় আড়াইশ রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করা হয়। যাদের সবাই বিভিন্ন ক্যাম্পের বাসিন্দা। গত ১৪ নভেম্বর দুপুরে বঙ্গোপসাগরের সেন্টমার্টিন দ্বীপ থেকে ১২২ জন রোহিঙ্গাকে ভাসমান ট্রলার থেকে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড সদস্যরা। উদ্ধারকৃতদের মধ্যে ১৫ জন শিশু, ৫৯ জন নারী ও ৪৮ জন পুরুষ ছিল। সর্বশেষ গত ১৬ নভেম্বর উখিয়ার সোনারপাড়ায় একটি কটেজে মালয়েশিয়ায় পাচারের জন্য রাখা অবস্থায় ১১ রোহিঙ্গাকে আটক করে ইনানী পুলিশ ফাঁড়ির সদস্যরা।

জানা যায়, অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়া পাড়ি জমাতে গিয়ে ২০১৩-২০১৪ সালে কয়েক হাজার বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা সাগরে ডুবে যায়। এদের মধ্যে অনেকে মারাও যায়। এর মাঝে বাংলাদেশে ২০১৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত নারী পাচারের সংখ্যা এক হাজার ৪৩৭ জন। তবে নারী পাচারের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি।

বাংলাদেশ পুলিশ ও জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছরই বাংলাদেশ থেকে ভারত, পাকিস্তান, সিরিয়া, লেবানন, জর্ডান, লিবিয়া, সৌদি আরব, কুয়েত, ওমান, বাহরাইন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার করা হচ্ছে নারী ও শিশুদের।

জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুসারে, ২০১৮ এর জানুয়ারি থেকে ২০১৯ এর জানুয়ারির মধ্যে দেড় হাজারের বেশি আশ্রয়প্রার্থী বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগর পাড়ি দিয়েছে। যা ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে সমুদ্র পাড়ি দেওয়া মানুষের তুলনায় প্রায় ৫০ গুণ বেশি। ২০১৫ সালে সমুদ্রযাত্রীদের বেশিরভাগই ছিল পুরুষ, কিন্তু ২০১৮ সালের সমুদ্রযাত্রীদের শতকরা ৫৯ ভাগই নারী ও শিশু। এদিকে বাংলাদেশ থেকে বছরে যে পরিমাণ মানব পাচার হয়, তার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ নারী ও শিশু। জাতিসংঘের একটি পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত সময়ে দেড় বছরে এদেশ থেকে পাচার হওয়াদের মধ্যে ৩৬ শতাংশই ছিল নারী আর শিশু ১৫ শতাংশ।

মানব পাচারকারীর সুবিধাজনক পয়েন্ট
ট্রলারে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পাঠানোর জন্য মানবপাচারকারীরা কক্সবাজার উপকূলের ১৮টি পয়েন্ট ব্যবহার করছে। এর মধ্যে টেকনাফের শামলাপুর, শীলখালি, রাজারছড়া, জাহাজপুরা, সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ, কাটাবনিয়া, মিঠাপানির ছড়া, জালিয়াপালং, ইনানী, হিমছড়ি, রেজুখাল, কুতুবদিয়াপাড়া, খুরুশকুল, চৌফলদণ্ডী, মহেশখালী। সীতাকুণ্ড ও মাঝিরঘাট এলাকা হয়ে ট্রলারে মানবপাচার হয়ে থাকে। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে স্থানীয়সহ বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা।

এদিকে প্রশাসনের নজরদারির অভাবে ফের মানবপাচার শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ করেন স্থানীয়রা। স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন,‘দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকার পর আবারও সমুদ্রপথে অবৈধভাবে মানবপাচার শুরু হয়েছে। বিশেষ করে পাচারকারীরা রোহিঙ্গাদের টার্গেট করছে। এখনই সরকার মানবপাচার প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে অতীতের মতো বঙ্গোপসাগর ও আন্দামান সাগরে ঘটে যাওয়া ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জনপ্রতিনিধি বলেন, ‘প্রশাসনের অবহেলার কারণে সীমান্তে মানবপাচার হচ্ছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের একটি চক্র মানবপাচারের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। বিদেশ থেকে মানবপাচারের একটি চক্র তাদের সহযোগিতা করছে। ফলে ক্যাম্পে নজরদারি বাড়াতে হবে। না হলে মানবপাচার বড় রূপ নিতে পারে।’

তবে সম্প্রতি ক্যাম্প থেকে পালিয়ে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া যাত্রা কিংবা দেশের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে রোহিঙ্গা শিবিরের চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল কক্সবাজার জেলা পুলিশ।

কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এ সময়ে সমুদ্র শান্ত থাকায় পাচারকারীরা মানবপাচারের চেষ্টা করে থাকে। কিন্তু পাচার রোধে পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোয় নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে।’

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের তো এ ব্যাপারে অনেক পদক্ষেপই রয়েছে। প্রথমত জেলার কাউন্টার ট্রাফিকিং কমিটির সাথে প্রতিমাসেই বসা হয়। তারপর জেলা আইন শৃঙ্খলা কমিটির সাথে আলাপ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে কার্যক্রম চালানো হয়। বিশেষ করে আমাদের কোস্টগার্ড, বিজিবি সদস্যদের এলার্ট করে দেয়া আছে। এছাড়াও মানুষকে সচেতন করার জন্য এনজিওর মাধ্যমে বিভিন্ন রকম ক্যাম্পেইন করে থাকি। এভাবেই চেষ্টা করি যাতে মানবপাচার সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা যায়। মানবপাচার বন্ধে সরকার কঠোর অবস্থানে রয়েছে। কোনোভাবেই মানবপাচার হতে দেওয়া হবে না। কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!