শর্টসার্কিটের গোপন ঘাতক আগুনে পোড়াচ্ছে চট্টগ্রামকে

১ বছরেই দুর্ঘটনা হাজার পার

পোড়া কাপড়ের স্তূপে বসে অপলক দৃষ্টিতে একদিকে তাকিয়ে আছেন ষাটোর্ধ নুরুল আলম। চাহনি দেখে মনে হতে পারে বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। চোখ দিয়ে বেয়ে পড়ছে পানি। ৫০ লাখ টাকার পোড়া কাপড়ের স্তূপে বসে বুক পকেটে হাত দিতেই দেখেন আছে শুধু ৫০ টাকা। সামনে এগিয়ে কথা বলতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলছেন, কলেজপড়ুয়া বড় ছেলেকে একটা মোবাইল কিনে দেওয়ার কথা ছিল। মেয়ের সংসারে নতুন অতিথির আগমন উপলক্ষে তার শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের দাওয়াত দেয়ার কথা ছিল।

সব শেষ! সব শেষ। এই দেখেন, আমার একমাত্র সম্বল এখন এই ৫০ টাকা! কী করবো আমি? এমন অনেক ছোট ছোট স্বপ্ন ছিল নুরুল আলমের। আশা ছিল অল্প অল্প করে ব্যবসায় থেকে লাভ হওয়া সঞ্চয় থেকেই স্বপ্নগুলো পূরণ করবেন। কে জানতো ছুটি কাটিয়ে কাজে ফিরে আসার আগেই নুরুল আলমের স্বপ্ন আগুনে পুড়ে ছাই হবে।

গত বছরের ১৯ অক্টোবর ভোর রাত ৩টা ৫০ মিনিটের দিকে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে লাগা আগুনে নগরীর শাহ জালালাবাদ মার্কেটের মার্কেটের দোতলার ৮০টি দোকানের পণ্যসামগ্রী পুড়ে ছাই হয়ে যায়। প্রায় ২০টির মতো গোডাউন, কারখানা পুড়ে গেছে। সেই আগুনে পাশের জহুর হকার্স মার্কেটের অন্তত ৩০টি দোকান পুড়ে যায়। এভাবেই বৈদ্যুতিক ত্রুটির কারণে আগুনে নিঃস্ব হয়েছেন নুরুল আলম এবং তার মতন আরও অনেক ব্যবসায়ী। প্রায় শতাধিক ব্যবসায়ীর গগনবিদারী আহাজারিতে জুহুর হকার্স মার্কেটের পরিবেশ গুমোট ছিল অনেকদিন।

দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন। এই আগুনে পুড়ছে মানুষ, পুড়ছে দোকান, পুড়ছে থাকার ঘর আর সাথে সাথে পুড়ে ছাই হয় কত শত জীবনের রঙিন স্বপ্ন। প্রায় প্রতিদিনই নগরীর কোথাও না কোথাও আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে। আর বেশিরভাগই হচ্ছে বৈদ্যুতিক ত্রুটির কারণে।

বছর বছর এভাবে বাড়ছে অগ্নি দুর্ঘটনা। বাড়ি বা ভবন বানানোর আগে অগ্নি নির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা না রাখায় বাড়ছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। যার জলজান্ত উদাহরণ ডেকোরেশন গলির বাবু কলোনির বস্তি। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যাওয়ার পরেও বেশ অনেকটা সময় আগুনের ধারেকাছে যেতে পারেনি ফায়ার সাভির্সের কর্মীরা।

গত পাঁচ বছরের তুলনায় গত বছরেই (২০১৯ সালে) সবচেয়ে বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামে। যার সবকটিই বৈদ্যুতিক ত্রুটিজনিত। যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও অনেক। ২০১৯ সালে অগ্নিকাণ্ডের এক হাজার ৭৮টি ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২৭ কোটি টাকার। এসব ঘটনায় মারা গেছেন ২০ জন। অন্যদিকে ২০১৭ সালে ৬৬৩টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৪৭ কোটি টাকার।

ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদন অনুযায়ী চট্টগ্রামে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ২০০টি। মহানগরে ১৫০টি ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ ও ৫০টিকে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করা হয়েছে। খুবই ঝুঁকির তালিকায় রয়েছে ২৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ১৭টি বিপণিবিতান ও চারটি হাসপাতাল-ক্লিনিক। অন্যদিকে ৩৪টি বিপণিবিতান, ৫৯ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৩৬টি ব্যাংক ও ২১টি হাসপাতাল-ক্লিনিককে ঝুঁকিপূর্ণ বলা হয়েছে। মোট ২০৪টি ভবন পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস এ প্রতিবেদন দেয় ।

জানা গেছে, নগরীর ৯৭ শতাংশ বহুতল ভবনে অগ্নি নিরাপত্তার ছাড়পত্র নেই। ফায়ার সার্ভিস এসব ভবন ঝুঁকিপূর্ণ বলে ঘোষণা করলেও তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই ভবন মালিকদের। ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের মধ্যে রয়েছে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন। এছাড়া পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় ব্যস্ততম ৪১টি মার্কেটকেও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। একের পর এক বহুতল ভবন গড়ে উঠলেও ফায়ার সার্ভিস থেকে নেওয়া হচ্ছে না অনাপত্তিপত্র (এনওসি)। একইভাবে ভবন তৈরির পর নেওয়া হয় না বসবাসের উপযোগী ঘোষিত ছাড়পত্রও। ফলে বাড়ছে দুর্ঘটনার ঝুঁকি।

চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানিয়েছে, নগরীতে প্রায় সাত থেকে আট হাজার বহুতল ভবন রয়েছে। ছয়তলার বেশি উচ্চতার ভবনগুলোকে বহুতল ভবন হিসেবে দেখা হয়। এ ধরনের ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রথমে অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে অনাপত্তিপত্র এবং ভবন নির্মাণের পর তাতে প্রয়োজনীয় অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে কিনা তার জন্য নিতে হয় ছাড়পত্র। অনাপত্তিপত্রে অগ্নি নিরাপত্তা এবং দুর্ঘটনা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ১৮টি শর্ত দেওয়া হয়। ভবন তৈরি শেষে ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শক দল শর্তগুলো মানা হয়েছে কিনা পরীক্ষা শেষে বসবাস উপযোগী ছাড়পত্র দিয়ে থাকে। কিন্তু ভবন মালিকেরা অগ্নি নিরাপত্তায় মানছে না কোনো নিয়ম।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সহকারী পরিচালক মো. আজিজুল ইসলাম চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি এখানে দায়িত্ব পেয়েছি বেশিদিন হয়নি। তবে সাধারণত নগরীতে বহুতল ভবনের অনুমতি দেয় সিডিএ। ২০১৮ সাল থেকে গত বছরের ফেব্রুয়ারির জরিপে দেখা যায় যে ভবনের কাজ শুরুর আগে আমাদের কাছ থেকে অনাপত্তিপত্র নেয়নি ৯৩ শতাংশ ভবনের মালিক। ভবন নির্মাণ শেষ হওয়ার পর আমাদের কাছ থেকে অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ক ছাড়পত্র নেওয়ার বিধান আছে, কিন্তু তাও নেই ৯৭ শতাংশ ভবনের। এসব ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতের কোনো ব্যবস্থাই নেই। যদি আগুন লাগে, কিভাবে নিজেকে সুরক্ষিত রাখবে তারও কোনো প্রশিক্ষণ নেই ভবনের বাসিন্দাদের। এখানকার প্রায় সব বহুতল ভবনই বলতে গেলে আগুনের ঝুঁকিতে আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভবন হবে— হয় শুধু আবাসিক নতুবা শুধু বাণিজ্যিক। দুইভাবে ব্যবহারের কারণে ঝুঁকিটা সবচেয়ে বেশি। আমরা নোটিশ পাঠাচ্ছি। তবে ভবন নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থাকেও এগিয়ে আসতে হবে। এ বছর প্রায় ২৩ কোটি টাকার ওপরে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। প্রায় ৬০ কোটির বেশি মালামাল উদ্ধার করেছি। আর বৈদ্যুতিক ত্রুটির কারণেই বেশিরভাগ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ থেকে রক্ষা পেতে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে, সেই সাথে নিজেকেও সতর্ক থাকতে হবে। ছয় মাস বা এক বছর পর পর ইলেকট্রিশিয়ান বা প্রকৌশলীর মাধ্যমে বৈদ্যুতিক স্থাপনা, ফিটিংস ও ওয়্যারিং পরীক্ষা করে নিতে হবে। ভবনে ব্যবহৃত আসবাব অগ্নিনিরোধক হতে হবে। ফায়ার এক্সিট আগুন, সিগারেটের ধোঁয়া ও তাপমুক্ত হতে হবে।’

এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি আশিক ইমরান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আইন আছে, কিন্তু মানার মত কেউ নেই। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দোষী ভবন মালিকেরা। তারা এক রকম বানাবে বলে অনুমোদন নেয় আর করে আরেক রকম। জরিমানা করেও কোনো লাভ হয় না। আবার সংশ্লিষ্ট যারা তারাও আন্তরিক না। আর এ কারণে যেকোনো মুহূর্তে একটা বিপর্যয় সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখানে আসলে অনেক সমস্যা। ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ অনুযায়ী ভবন নির্মাণ শেষ হওয়ার পর সিডিএকে চিঠি দেবে। সিডিএ সব দেখে সঠিক পেলে বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সংযোগ যাবে। কিন্তু আমাদের এখানে এসবের কিছুই হয় না। লোকবল সংকট দেখিয়ে যে যার দায়িত্ব এড়িয়ে যায়। আর এর ফলাফল তো তারা পরে পায়।’

এসআর/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!