শরীরে এশিয়ান পেপার মিলের বিষ নিয়ে বইছে হালদা

উৎপাদন বন্ধ রাখার নির্দেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের

বছরের পর বছর বিষাক্ত বর্জ্য ফেলে হালদা নদীকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেললেও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নোটিশ-জরিমানা কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করছে না চট্টগ্রামের হাটহাজারীর নন্দীরহাটে স্থাপিত এশিয়ান পেপার মিল৤ টানা অন্তত ১০ বছর ধরে নিরবে হালদাকে নিরবচ্ছিন্নভাবে দূষণ করে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি।

সর্বশেষ রোববার (১৮ আগস্ট) বর্জ্য ফেলে দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননকেন্দ্র হালদা নদী দূষণের দায়ে চিটাগং এশিয়ান পেপার মিলসের উৎপাদন বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। পাওয়া গেছে হালদা দূষণের সুনির্দিষ্ট প্রমাণও৤

এশিয়ান পেপার মিলসের স্বত্ত্বাধিকারী বিজিএমইর প্রথম সহ সভাপতি এবং চট্টগ্রাম চেম্বার ও এফবিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক এশিয়ান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ সালাম। গত মার্চে তিনি চট্টগ্রাম নগরীর বাগমনিরাম ওয়ার্ডে প্রাথমিক সদস্যপদ পূরণ করে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।

জানা গেছে, বিভিন্ন সময়ে শুধু ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নোটিশ-জরিমানা-সতর্কতা সবকিছুকেই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এসেছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার এম এ সালাম। অন্তত ১০ বছর ধরে দিনের পর দিন বিষাক্ত বর্জ্য ফেলে হালদার অপূরণীয় ক্ষতি করে এলেও তরল বর্জ্য শোধনাগারে (ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) এতোটুকু আগ্রহ দেখা যায়নি প্রতিষ্ঠানটির। পরিবেশ অধিদপ্তরের কাছে অভিযোগ গেলে কেবল নোটিশ আর জরিমানার ‌‘ইঁদুর-বিড়াল’ খেলাই চলে৤

পরিবেশ অধিদপ্তরের সঙ্গেও প্রতিষ্ঠানটির সম্পর্ক অনেকটা প্রীতি ও প্রশ্রয়ের। ১০ বছর ধরে মধুর ‘ইঁদুর-বিড়াল’ খেলা চলে আসছে এই দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে।

প্রতিষ্ঠান স্থাপনের ৫ বছরের মাথায় ২০১৪ সালের ৩ মার্চ ইটিপিবিহীন কারখানা পরিচালনার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে এক কোটি ১৫ লাখ ৬৩ হাজার ২০০ টাকা ক্ষতিপূরণ ধরা হয়। এশিয়ান পেপার মিলের আপিলে পরে এক কোটিরও বেশি টাকা বাদ দিয়ে নির্ধারিত হয় শুধু ১৫ লাখ ১৯ হাজার ২০০ টাকা। দ্বিতীয় দফায় ২০১৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি এশিয়ান পেপার মিলকে জরিমানা করা হয় ৭ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। এরপর একই বছরের ৮ নভেম্বর ইটিপিবিহীন কারখানা পরিচালনার জন্য পুনরায় জরিমানা করা হয় ১ লাখ ৯৬ হাজার টাকা এবং তাও তা পরিশোধ করে প্রতিষ্ঠানটি। সর্বশেষ চলতি বছরের ১০ জুন দূষণের অভিযোগে ফের ২০ লাখ টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। কিন্তু ওই জরিমানার টাকা পরিশোধ না করেই প্রতিনিয়ত বর্জ্য ছেড়ে হালদা দূষণ করে চলেছে প্রতিষ্ঠানটি।

এভাবে বছরের পর বছর কেবল নোটিশ ও জরিমানার ‘ইঁদুর-বিড়াল’ খেলাই চলছে। কিন্তু এতোকিছুর পরও হালদা নদীতে এশিয়ান পেপার মিলের বর্জ্য ফেলা বন্ধ হয়নি একদিনের জন্যও। তরল বর্জ্য শোধনাগার (ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) চালুরও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি৤

দেখা গেছে, প্রতিবারই জরিমানা ঘোষণা শেষে ইটিপি স্থাপনের নির্দেশ দেওয়ার পরও প্রশাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পার পেয়ে যায় এশিয়ান পেপার মিল। সর্বশেষ জরিমানার পর এক মাসের মধ্যে ইটিপি কার্যকর করার নির্দেশ থাকলেও তার তোয়াক্কা না করে ঈদের ছুটির সুযোগে গত ১১ আগস্ট রাতে জমানো বর্জ্য ছেড়ে দেওয়া হয় হালদার জলে। যার প্রমাণ হাতেনাতে পায় উপজেলা প্রশাসন। এ প্রেক্ষিতে রোববার (১৮ আগস্ট) শুনানি শেষে ইটিপি স্থাপন না করা পর্যন্ত উৎপাদন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর। সংস্থাটি জানায়, প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন পয়েন্টে পানির নমুনা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে যে মান-মাত্রা পাওয়া যায় তা পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ১৯৯৭ এর মান মাত্রাবর্হিভূত।

এদিনের শুনানিতে এশিয়ান পেপার মিলস কর্তৃপক্ষকে সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ইটিপির ত্রুটি সংশোধন ও সার্বক্ষণিক চালু রাখার পদক্ষেপ গ্রহণ, পরিবেশসম্মত স্লাজ অপসারণের যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না হওয়া পর্যন্ত উৎপাদন বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। শুনানিতে চিটাগাং এশিয়ান পেপার মিলস (প্রাইভেট) লিমিটেডের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) সফিউল আলম এবং ব্যবস্থাপক এহছানুল হক আজাদ।

ঈদকে সামনে রেখে মানুষের ব্যস্ততার সুযোগে হালদা নদীতে পানি ছেড়ে দিয়েছে এশিয়ান পেপার মিল।
ঈদকে সামনে রেখে মানুষের ব্যস্ততার সুযোগে হালদা নদীতে পানি ছেড়ে দিয়েছে এশিয়ান পেপার মিল।

এর আগে গত ১০ জুন তরল বর্জ্য শোধনাগার (ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) ছাড়া কারখানা চালানো এবং কারখানার ভেতরে একটি প্রাকৃতিক পুকুরে রাসায়নিক মিশ্রিত তরল বর্জ্য সংরক্ষণের প্রমাণ পাওয়ায় পরিবেশ অধিদপ্তর প্রাথমিকভাবে ‘এনভায়রনমেন্টাল ড্যামেজ এসেসমেন্ট’ করে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করে এশিয়ান পেপার মিলকে। পাশাপাশি এক মাসের মধ্যে ইটিপি সম্পূর্ণরূপে কার্যকর করা এবং প্রাকৃতিক পুকুরে রাসায়নিক মিশ্রিত তরল বর্জ্য সংরক্ষণ করা হবে না মর্মে ২৩ জুনের মধ্যে অঙ্গীকারনামা দিতে এশিয়ান পেপার মিলকে নির্দেশ দেয়। কিন্তু ওই নির্দেশ আমলেই নেয়নি এশিয়ান পেপার মিল।

এদিকে গত ১১ আগস্ট এশিয়ান পেপার মিলের ছাড়া নমুনা নিয়েছেন হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রুহুল আমিন। এশিয়ান পেপার মিল যে রাতের আঁধারেই ময়লা পানি ছেড়ে দেয় হালদায়—এর স্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে ইউএনওর সরেজমিন পরিদর্শনে। নমুনা পানি পরীক্ষা করে প্রমাণ পাওয়ায় প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বন্ধের নির্দেশ দেয় পরিবেশ অধিদপ্তর।

হাটহাজারীর ইউএনও মো. রুহুল আমীন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, সুযোগ বুঝে এশিয়ান পেপার মিল তাদের বিষাক্ত বর্জ্য নদীসংলগ্ন ছড়ায় ছেড়ে দেয় যা সরাসরি হালদা গিয়ে পড়ে। ১১ আগস্ট রাতে পার্শ্ববর্তী ছড়াটি থেকে দুই বোতল নমুনা সংগ্রহ করে পরিবেশ অধিদপ্তরে পাঠাই। এরপর কারখানাটিতে গিয়ে দেখতে পাই বস্তা দিয়ে একটি জলাধারের মত তৈরি করা হয়েছে। বায়োলজিক্যাল প্ল্যান্টের ট্যাংকটি প্রায় ভরপুর। একটু বৃষ্টি হলেই সেখান থেকে বর্জ্য গড়িয়ে বাইরে পড়তে পারে এমনভাবে ব্যবস্থা করা। পাশে আরেকটি ছোট্ট সংযুক্ত ট্যাংক আছে যেটা দিয়ে বর্জ্য বাইরের ছড়ায় চলে যাওয়ার সুযোগ রাখা আছে। যাতে সহজেই হালদায় পড়ে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক এবং প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রচুর বৃষ্টি হলে এবং দুই ঈদের ছুটিতে তারা জমিয়ে রাখা বর্জ্য ছেড়ে দেয়, যা অত্যন্ত অনৈতিক। হালদা নদীকে বাঁচাতে হলে এশিয়ান পেপার মিলকে এখান থেকে সরিয়ে নিতে হবে। এটাই আমাদের দাবি।
একই অপরাধে যদি অন্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয় তাহলে এটি বছরের পর বছর ধরে ইটিপি ছাড়াই কেন কার্যকর থাকবে?’

পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মুক্তাদির হাসান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘১৪ আগস্ট প্রতিষ্ঠানটি পরিদর্শন করে সেখানকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খুবই নাজুক দেখতে পাই। ইতোপূর্বে বহুবার প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ক্ষতিপূরণ আরোপ এবং তাদের সতর্ক করা হলেও তারা কোনো প্রকার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির স্লাজ খোলা স্থানে রাখা হয়েছে, যা বৃষ্টির পানিতে সহজেই ধুয়ে পার্শ্ববর্তী খালে গিয়ে মরাছড়া খাল হয়ে সরাসরি হালদায় পড়ে। এ অবস্থায় ইটিপি কার্যকরভাবে চালু না হওয়া পর্যন্ত উৎপাদন বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে৤’

এ প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক মো. এহছানুল হক আজাদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের ইটিপি কার্যকর আছে। তবে ঈদের আগের ঘটনাটা একটা দুর্ঘটনা ছিল। এ কথা তো পরিবেশের অঞ্চলের কর্মকর্তারা বোঝেন না। আমাদের ইটিপি স্থাপনের যে পরিকল্পনা সে অনুযায়ী দ্রুত কাজ শেষ করতে বলেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। ওই কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপাতত উৎপাদন বন্ধ রাখতে বলেছে।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!