শত বাধা পেরিয়ে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিনাত সোহানার অদম্য লড়াই

জিনাত সোহানা চৌধুরী। চট্টগ্রাম তো বটেই, সারাদেশে তরুণ প্রজন্মের কাছে একটি অতিপরিচিত নাম। যিনি করোনার ভরা যৌবনে তার চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে সম্মুখ সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন করোনাযুদ্ধে। দিনরাত করোনা রোগীদের পাশে থেকে পরম মমতায় তাদের সুস্থ করেছেন। চট্টগ্রামের শতাধিক মাদ্রাসায় গিয়ে হাজারো শিক্ষার্থীর সমবেত কন্ঠে জাতীয় সংগীত, জয় বাংলা স্লোগান ধ্বনিত করে দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের শুনিয়েছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের গল্প। তাদের শপথ করিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ধারণ করে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার।

মনোবল থাকলে দেশের জন্য কাজ করতে নারীত্ব যে কোনো বাধা নয় তা তিনি দেখিয়ে দিচ্ছেন প্রতিনিয়ত। দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে চারদিক থেকে এসেছে শত বাধা, এসেছে প্রাণনাশের হুমকিও। তবুও তিনি দমে যাননি। বরং এগিয়ে গেছেন দ্বিগুণ উৎসাহে। তরুণ সংগঠক, রাজনীতিক ও আইনজীবী জিনাত সোহানা চৌধুরী এভাবে অনেকের কাছেই ‘আইকন’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।

সমাজ থেকে অশিক্ষা, কুসংস্কার, জঙ্গিবাদ নির্মূল, নারীর ক্ষমতায়ন সমসুযোগ, সম-অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমৃত্যু তিনি কাজ করতে চান। করোনাকালে নারী তো দূরের কথা, পুরুষরাই যেখানে নিজেদের ঘরের মধ্যে আবদ্ধ রেখেছে, করোনা হলেই স্বজনরা যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তিকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন, সেখানে তিনি নারী হয়ে তাদের চিকিৎসায় রাতদিন বিরামহীন ছুটে বেড়িয়েছেন। অদম্য করোনাকালে সহস্রাধিক মানুষকে দিয়েছেন খাদ্য ও অর্থ সহায়তা।

শত বাধা পেরিয়ে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিনাত সোহানার অদম্য লড়াই 1

সমমনা কয়েকজন তরুণকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তুলেছেন করোনা আইসোলেশন সেন্টার। যা পরে রূপ নেয় ট্রিটমেন্ট সেন্টারে। এজন্য তিনি ফান্ড সংগ্রহ করা, ডাক্তার ও নার্সদের বেতনের ব্যবস্থা করা, করোনার নমুনা সংগ্রহের বুথ স্থাপন, এক্স-রে মেশিন, সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম, হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানোলা জোগাড়েও ছিলেন সচেষ্ট। এই সেন্টারের প্রতি আস্থা রেখে সাড়ে আট শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিয়েছেন।

চট্টগ্রাম শুধু নয়, আশেপাশের জেলা থেকেও এসেছেন অনেকেই। এমন মায়া ছড়ানো আইসোলেশন সেন্টারটির মুখপাত্র ছিলেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান জিনাত সোহানা চৌধুরীর বাড়ি রাউজানের গহিরায়। ছাত্রলীগের মাধ্যমে তার রাজনীতির হাতেখড়ি। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, চট্টগ্রাম জেলা আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর হিসেবে দায়িত্বের পাশাপাশি তিনি বেসরকারি কারা পরিদর্শকের দায়িত্বও পালন করছেন।

শত বাধা পেরিয়ে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিনাত সোহানার অদম্য লড়াই 2

এছাড়া ‘সুচিন্তা বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠনের চট্টগ্রাম বিভাগের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেলের অন্যতম সদস্য এই নারী নেত্রী। এসব কিছু নিয়ে নারী দিবসে চট্টগ্রাম প্রতিদিনের মুখোমুখি হয়েছেন জিনাত সোহানা।

তিনি বলেন, ‘আমাদের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক নারী। শহরাঞ্চলে নারী শিক্ষা কিছুটা ব্যাপক আকারে থাকলেও গ্রামাঞ্চলে নারী শিক্ষার অবস্থা খুবই করুণ। তাই এ বিপুল জনগোষ্ঠীকে নিরক্ষর, অবহেলিত ও অদক্ষতায় পেছনে রেখে দেশের সার্বিক উন্নয়ন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। একটি দেশের উন্নয়নের পূর্বশর্ত নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন। সমাজে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নারীদের অবস্থান দৃঢ় হয়। পরিবারে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখতে পারেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘নারীর ক্ষমতায়ন, সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় উন্নয়নের মূলধারায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে দারিদ্র্যমুক্ত সুখী-সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে নারী-পুরুষ সবাইকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতে নারীদের অবস্থান বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। এটি একদিকে যেমন নারী জাতির অস্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ, তেমনি নারীর ক্ষমতায়নের বিশেষ দিক। রাজনীতিতে প্রবেশাধিকার নারীদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। কারণ রাজনীতিতে নারীকে সম্পৃক্ত করা নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম ধাপ।’

শত বাধা পেরিয়ে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিনাত সোহানার অদম্য লড়াই 3

জিনাত সোহানা বলেন, ‘বর্তমান সরকারের বলিষ্ঠ পদক্ষেপ ও নেতৃত্বে উন্নয়ন আজ দৃশ্যমান। ব্যবসা-বাণিজ্য, রাজনীতি, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, কূটনীতি, সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, শান্তিরক্ষা মিশনসহ সবক্ষেত্রে নারীর সফল অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশ ক্রমান্বয়ে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। নারীর জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করায় নারীর ক্ষমতায়নে শক্ত ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এতকিছুর পরও নারী নির্যাতন এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও নারী নির্যাতনের খবর গণমাধ্যম আসছে। সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের বিস্ময়কর সাফল্যের পেছনে নারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। তাই নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ কতটা হচ্ছে, আইনগুলো কীভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা নিয়মিতভাবে তদারক করা প্রয়োজন।’

নারী হয়েও জঙ্গিদের মতো ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কেন লড়াইয়ে নামলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আসলে স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে মেয়েদের কাজ করা খুব একটা সহজ নয়। আর জঙ্গিবাদের মতো বিষয় তো আরও বেশী কঠিন। আমি মনে করি বাংলাদেশের মানুষরা সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করেছেন। এই দেশের জন্য ত্রিশ লক্ষ মানুষ তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। অসংখ্য মা বোন তাদের সম্ভ্রম হারিয়েছেন। আর কত ত্যাগ শিকার করেছেন এই দেশের মানুষ। এত কিছুর বিনিময়ে যে দেশটা স্বাধীন হলো, গুটিকয়েক বিপদগামী জঙ্গিদের কারণে তা শেষ হতে পারে না। মূলত এই বিষয়টা চিন্তা করে আমি জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কাজ করা শুরু করি।’

কাজ করতে গিয়ে বাধা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জঙ্গিবাদ নির্মূলে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে নানান সময় প্রাণনাশের হুমকি এসেছে। রগ কেটে ফেলবে, পঙ্গু করে দিবে বলেও হুমকি এসেছে। তবু আমি আমার কাজ বন্ধ করিনি। এখনো আমি বুকে অদম্য সাহস রেখে কাজ করে যাচ্ছি। যতদিন বাঁচবো ততদিন জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কাজ করে যাবো।’

শত বাধা পেরিয়ে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিনাত সোহানার অদম্য লড়াই 4

করোনাকালীন কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘মহামারী করোনাভাইরাস যখন দেশে প্রথম শনাক্ত হয়, তখন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংকট মোকাবেলায় সবাইকে কাজ করতে নির্দেশ দেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন সৈনিক হয়ে তখন সেটা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছি আমি। ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন কাজের পাশাপাশি কয়েকজন তরুণকে নিয়ে নিজেরাই গড়ে তুলি করোনা আইসোলেশন সেন্টার। এই মহামারি যেহেতু সরকারের একার পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না, তাই তরুণদের সাথে নিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ শুরু করি।’

তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রামে করোনার প্রকোপ বাড়ার সাথে সাথে চট্টগ্রামের বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগীদের ভর্তি না নেওয়ার অভিযোগ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বেসরকারি হাসপাতালগুলো করোনা রোগী তো দূরের কথা, সাধারণ শ্বাসকষ্টের রোগীকেও ভর্তি না নেওয়ায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগ আসতো প্রতিদিনই। সামান্য অক্সিজেনের অভাবে রোগী মারা যাচ্ছিল। করোনা ছিল একটা আতঙ্ক— যখন করোনা হলেই সন্তান ছেড়ে মা-বাবা চলে যাচ্ছে, মা-বাবাকে সন্তান রেখে আসছে গভীর জঙ্গলে। নিজের মা-বাবার সৎকারে সন্তানরা এগিয়ে আসছে না, আত্মীয়স্বজন ঘর থেকে বের করে দিচ্ছে করোনা হলে। এত এত অভিযোগ শুনে দেশপ্রেম থেকে, দেশকে ভালোবেসে, দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে আমরা এগিয়ে আসি।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!