‘লেনদেনের কমিটি’র পরদিনই ৬ শীর্ষ ছাত্রলীগ নেতার হঠাৎ বৈঠক পেনিনসুলায়

উত্তরের ‘প্রস্তাবে’ মহানগর ও দক্ষিণ জেলার ‘না’

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলা ছাত্রলীগের কমিটি গঠনে ‘২০ লাখ টাকা লেনদেনের’ অভিযোগকে ঘিরে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার মাঝে হঠাৎ করেই চট্টগ্রাম মহানগর ও উত্তর-দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতারা একটি বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। চট্টগ্রামের তিন ইউনিটের শীর্ষ নেতাদের এমন আচমকা এই বৈঠককে ঘিরে কৌতূহল তৈরি হয়েছে এসব ইউনিটের নেতাকর্মীদের মধ্যে।

তিন ইউনিটের শীর্ষ নেতারা আগেও এই ধরনের বৈঠকে একাধিকবার বসেছেন বলে দাবি করলেও এই প্রথমবারের এ ধরনের কোনো ‘গোপন’ সভার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। কমিটি গঠনে ‘চাঁদাবাজি’র অভিযোগ ওঠার পরদিনই কেন হঠাৎ এই অনির্ধারিত বৈঠক— এমন প্রশ্নে স্বাভাবিকভাবেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে এসব এলাকার নেতাকর্মীদের মধ্যে।

বুধবার (১৮ নভেম্বর) সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম জিইসি মোড় এলাকার অভিজাত হোটেল পেনিনসুলায় হওয়া এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ ইমু ও সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি তানভীর হোসেন চৌধুরী তপু ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রেজাউল করিম এবং চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এসএম বোরহান উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের। হোটেল পেনিনসুলা আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের মালিকানাধীন।

নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে, মূলত সীতাকুণ্ড উপজেলা কমিটি গঠনে টাকা লেনদেনের বিতর্কের প্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের আগ্রহেই এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। যেখানে এই বিষয়ে তিন ইউনিটের পক্ষ থেকে একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলন করার প্রস্তাবও দেয়া হয়। কিন্তু চট্টগ্রাম মহানগর ও দক্ষিণ জেলা শাখার নেতারা যৌথ সংবাদ সম্মেলনের সেই প্রস্তাবে রাজি হননি।

তবে বৈঠকে উপস্থিত নেতারা বলছেন, এই বিষয়ে কোনো আলোচনাই ওই বৈঠকে হয়নি। তাহলে হঠাৎ কেন এই বৈঠক— চট্টগ্রাম প্রতিদিনের এই প্রশ্নের জবাবে বৈঠকে উপস্থিত তিনজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ভিন্ন ভিন্ন উত্তর।

চট্টগ্রাম জিইসি মোড়ের হোটেল পেনিনসুলায় হওয়া বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ও দক্ষিণ জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা।
চট্টগ্রাম জিইসি মোড়ের হোটেল পেনিনসুলায় হওয়া বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ও দক্ষিণ জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা।

এটিকে ‘নিয়মিত আড্ডা’ হিসেবে অভিহিত করে সেখানে কোনো ‘পলিটিক্যাল আলাপ’ হয়নি জানিয়ে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি এসএম বোরহান বলেন, ‘আমরা এমনিই বসেছি। এরকম আমরা মাঝে মাঝে বসি। আজকে সবাই ফ্রি ছিলাম, এজন্য বসা। এরকম কোন কিছু না। এমনিতে আমরা অনেকদিন ধরে বসি নাই। সময় পাই নাই। আজ সময় পাইছি— বললাম চল আড্ডা মারি। আমরা আমাদের কথা বললাম। অন্য কোন বিষয় কিংবা অন্য কোন ইস্যু ছিল না। কারণ রাজনীতিটা যে যার ইউনিটের মত করে করবে। আর আমরা আজকে বসছি তা না, আমরা মাঝে মাঝেই বসি।’

অন্যদিকে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীর বলেন, ‘আমরা মূলত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে ইসলামিক দলগুলো যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করছে তা মোকাবেলায় তিন ইউনিট যৌথভাবে কাজ করার বিষয়ে আলোচনা করেছি।’ তবে সীতাকুণ্ড ছাত্রলীগের কমিটি বিতর্ক সামাল দিতেই কি এই বৈঠক— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এগুলো নিয়ে কোনো কথা সেখানে হয়নি। আমরা এমনিতে বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত বসি।’

একই ধরনের বক্তব্য চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি তানভীর হোসেন চৌধুরী তপুরও। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির যে আস্ফালন, সেটি মোকাবেলার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কিভাবে কাজ করা যায় সেটি নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। আমরা তো প্রায়ই বসি। সবসময় হয়তো ছবি দিই না (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে)। আজকে ছবি দিসি। তো ভাগ্য ভাল যে সাংবাদিকরা আমাদের ছবিগুলো খুব গুরুত্ব সহকারে দেখে। ধন্য আসলে আমরা, বুঝতে পারছেন?’

অন্যদিকে সীতাকুন্ডের কমিটি গঠনে ২০ লাখ টাকার লেনদেনের অভিযোগ নিয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করতে চান না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এটার তো আসলে কোন ভিত্তি নাই। সো, এগুলো নিয়ে আসলে বলে সময় নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। আর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ অবগত আছে বিষয়গুলো। সো আই ডোন্ট ওয়ান্ট সে অ্যানিথিং।’

প্রসঙ্গত, এর আগে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটি ভেঙ্গে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের জন্য ২০ লাখ টাকা লেনদেনের অভিযোগ উঠে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে। এছাড়াও আগের আহ্বায়ক কমিটি বহাল রাখতে ২০ লাখ টাকা চাঁদা চাওয়ার অভিযোগও উঠে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী সীতাকুণ্ডের নতুন এই কমিটিকে ‘প্রেস কমিটি’ অভিহিত করে টাকা লেনদেনের অভিযোগ আনেন প্রকাশ্যে।

অভিযোগে জানা গেছে, পরে কমিটি বহাল রাখতে আট লাখ টাকা নেওয়ার পর অন্য পক্ষের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা পেয়ে আগের কমিটির কাছ থেকে নেওয়া আট লাখ টাকার সাত লাখ টাকা ফেরত দিয়েছেন রেজাউল করিম।

মঙ্গলবার (১৭ নভেম্বর) সকালে শিহাব উদ্দীনকে সভাপতি ও এসএম রিয়াদ জিলানীকে সাধারণ সম্পাদক করে সীতাকুণ্ড উপজেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ঘোষণা করেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি তানভীর হোসেন চৌধুরী তপু ও সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম।

এই কমিটিকে ‘প্রেস কমিটি’ অভিহিত করে ২০ লাখ টাকা লেনদেনের বিনিময়ে অছাত্র, হত্যামামলার আসামি ও সাবেক শিবির কর্মীকে দিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে অভিযোগ তোলেন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। নিজের ফেসবুক আইডিতে দেয়া এক স্ট্যাটাসে এই অভিযোগ তোলেন গোলাম রাব্বানী।

এছাড়াও আগের আহ্বায়ক কমিটি বহাল রাখতে জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম সীতাকুণ্ড ছাত্রলীগের আহ্বায়ক শায়েস্তা খানের কাছ ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে ৮ লাখ টাকা নিলেও পরে অন্যদের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা পাওয়ায় শায়েস্তার কাছ থেকে নেওয়া ৮ লাখ টাকার ৭ লাখ টাকা ফিরিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন গোলাম রাব্বানী।

এই ধরনের লেনদেনের দুটি কল রেকর্ডও চট্টগ্রাম প্রতিদিনের হাতে রয়েছে। যেখানে প্রথম কল রেকর্ডে জাবের নামে একজনকে বলতে শোনা যায়— ‘এখানে সেভেন কেন? এইট ছিল না, এইট?’ উত্তরে রেজাউল করিমকে বলতে শোনা যায়, ‘তাহলে একটা তোমাকে আমি পরে দিচ্ছি। অসুবিধা হবে?’ তখন জাবের বলেন, ‘না ভাই অসুবিধা নাই। আমি মাত্র দেখলাম, তাই বললাম।’

অন্য কলটি জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউলের সাথে সীতাকুণ্ড ছাত্রলীগের আহ্বায়ক শায়েস্তা খানের। যেখানে রেজাউলকে উদ্দেশ্য করে শায়েস্তা খানকে বলতে শোনা যায়, ‘আমারে ইরান ভাই (জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি) তোমারে ফোন দিতে বললো। আমি আসলে এসব দুই নম্বরী পছন্দ করি না। আমাকে তোমার ঘনিষ্ঠ অনেকে বলছে টাকা পয়সার লেনদেন ভিডিও করে রাখতে। কারণ পরে তুমি পল্টি নিতে পারো। আমি গাড়িতে বসে সেটা ভিডিও করে রাখছি।’ তখন রেজাউল বলেন, ‘ভাই আপনার সাথে আমার এগুলো লেনদেন নিয়ে কোন কথা হইছে?’ এর উত্তরে শায়েস্তা বলেন, ‘জাবেরের সাথে হইছে।’ তখন রেজাউল বলেন, ‘তাহলে জাবেরকে ফোন দিতে বলেন।’

কল রেকর্ডের বিষয়ে শায়েস্তা খান চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের আহ্বায়ক কমিটি টিকিয়ে রাখতে ২০ লক্ষ টাকা দাবি করেছিল রেজাউল। বাধ্য হয়ে পৈতৃক জায়গা বিক্রি করে তাকে ৮ লক্ষ টাকা দিই বহু কষ্টে। কিন্তু বর্তমান দুইজন ২০ লাখ টাকা দেয়াতে ৭ লাখ ফেরত দেয়। ১ লাখ টাকা এখনও রয়ে গেছে জেলা সেক্রেটারির কাছে।’

অন্যদিকে রেজাউল করিম পুরো বিষয়টি বানোয়াট বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘এগুলো বানানো কল রেকর্ড। এই ধরনের লেনদেনের কোন সত্যতা নেই।’

মেয়াদউত্তীর্ণ বলে সীতাকুণ্ড ছাত্রলীগের আহ্বায়ক কমিটি ভাঙ্গার কথা বলা হলেও সেটি ‘অযৌক্তিক’ দাবি করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী লিখেছেন, ‘তাদের আওতাধীন সাতটি উপজেলার সবকটিই মেয়াদউত্তীর্ণ। গত বছর একযুগ পুরোনো সীতাকুণ্ডের কমিটি করেছে। আর কিছুদিন পূর্বে মিরসরাই। অবশিষ্ট ৫টি কমিটি রিপন-রোটন ভাই ও সোহাগ-নাজমুল ভাইয়ের সময়কার অর্থাৎ গড়ে ৬-৮ বছর আগের পুরনো কমিটি বাদ দিয়ে। কাউকে কিছু না জানিয়ে ২০ লাখ টাকা আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে সীতাকুন্ডের কমিটি (গত বছর করা) ভেঙ্গে আজ নতুন প্রেস কমিটি করা হয়েছে!’

এমনকি চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের কমিটিও মেয়াদউত্তীর্ণ উল্লেখ করে গোলাম রাব্বানী আরও লিখেন, ‘চট্টগ্রাম উত্তর জেলা এক বছর মেয়াদি কমিটি আড়াই বছর পেরিয়ে গেলেও আজ অবধি পূর্ণাঙ্গ করতে পারেনি। আমাদের সময়ে বারবার তাগিদ দেয়ার পরও তারা পূর্ণাঙ্গ কমিটি জমা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তখন চট্টগ্রামের শ্রদ্ধাভাজন বর্ষীয়ান নেতা, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ ভাইয়ের কথায় তাদের সুযোগ দেওয়া হয়েছিলো।’

অছাত্র, বয়স উত্তীর্ণ ও শিবির কর্মীদের দিয়ে কমিটি করা হয়েছে বলে দাবি করে দাবির সপক্ষে প্রমাণও তুলে ধরেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক এই সাধারণ সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘নবনির্বাচিত সভাপতি বয়স উত্তীর্ণ এবং অছাত্র। সাধারণ সম্পাদক অছাত্র, হত্যা ও অপহরণ মামলার আসামি (চট্টগ্রাম ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের মামলা নং ৩৩৯/১৮)। ছাত্রলীগের কোথাও (তার) প্রাথমিক সদস্যপদও নাই, ইতিপূর্বে স্থানীয়ভাবে শিবিরের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলো। বাবা ওয়ার্ড জামায়াত নেতা, বড় ভাই ওয়ালিদ রনি উপজেলা বিএনপির সক্রিয় নেতা!’

অন্যদিকে ইতিবাচক কাজ করেও টাকার কাছে হেরে যাওয়া শায়েস্তা খানকে ‘মেধাবী ছাত্রনেতা’ হিসেবে অভিহিত করে গোলাম রাব্বানী বলেন, ‘আজ টাকার কাছে হেরে যাওয়া শায়েস্তা খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের মেধাবী শিক্ষার্থী। যোগ্যতম হিসেবেই ১০ বছর বছর যাবত একটা উপজেলার প্রার্থী। বাংলাদেশ ব্যাংকের এসিস্টেন্ট ডিরেক্টর পদে চাকরি পেয়েও যোগদান করেনি কেবল ছাত্রলীগকে ভালোবেসে। সুযোগ পেয়ে এই করোনা দুর্যোগে ছাত্রলীগের পক্ষে সর্বোচ্চ ইতিবাচক মানবিক কাজ করেছে— যার পুরস্কার আজকে পেয়েছে!’

এআরটি/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!