লিনাস টরভাল্ডস: লিনাক্সের পেছনের মহারথী

যেখানে পৃথিবীর খুব কমসংখ্যক মানুষের নিজের নামে একটা অপারেটিং সিস্টেমের নাম দেয়ার সৌভাগ্য নিয়ে জন্মায় সেখানে রয়েছে তার নামে একটি অপারেটিং সিস্টেম। এবং মজার ব্যপার হলো আপনি হয়ত এখন সেটি ব্যবহার করেই এই লেখাটি পড়ছেন। কি ভাবছেন? এনড্রয়েড অপারেটিং সিস্টমের জনকের কথা? যার কথা বলছি তাকে একদিক থেকে এনড্রয়েডের জনক বলে দাবী করা গেলেও আদতে তার অবদানটাকে বেশ ছোট করেই দেখা হয় তাতে। অনেকে হয়ত ধরে ফেলেছেন ইতোমধ্যে। আমি বলছি অপারেটিং সিস্টেম কার্নেল লিনাক্স (linux kernel) এর জনক লিনাস টরভাল্ডস (Linus Torvalds) এর কথা।

লিনাস টরভাল্ডসকে নিয়ে কথা বলতে গেলেই এককথায় লিনাক্সের নাম চলেই আসে। যদিও অপারেটিং সিস্টেমের কথা শুনলেই উইন্ডোজ (Windows) এর নীল লোগোর ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠে। তাই উইন্ডোজ কখনো না কখনো ব্যবহার করে দেখলেও কিন্তু কখনো ওভাবে লিনাক্সের নাম আপামর জনগন শুনেনি কিংবা শুনলেও ব্যবহার করে দেখেনি। কিন্তু কম্পিউটারে প্রত্যক্ষভাবে লিনাক্সের ব্যবহার না করলেও আমরা প্রতিদিন উঠতে বসতে লিনাক্সের ব্যবহার করে চলছি নিজের অজান্তেই। মুঠোফোন ব্যবহারে এন্ড্রয়েড থেকে ফেইসবুক ব্রাউজিং কিংবা ইউটিউবে ভিডিও স্ট্রিমিং সবখানেই আমরা ব্যবহার করে চলছি লিনাক্স সার্ভার। এমনকি বলা যায় লিনাক্স ছাড়া ইন্টারনেটের বর্তমান অস্তিত্বই অসম্ভব। মনে হচ্ছে চাপাবাজি? তবে প্রমাণসমেত জেনে নেই কিছু তথ্য।
লিনাস টরভাল্ডস: লিনাক্সের পেছনের মহারথী 1

alexa.com অনুসারে বর্তমানের সবথেকে বেশি ভিজিটেড ২৫টি ওয়েবসাইটের ২৩টিই তাদের সার্ভারে লিনাক্স ব্যবহার করে। যেসবের মধ্যে গুগল, নেটফ্লিক্স, এমাজন, ইউটিউব, ফেইসবুক সহ অনেক জনপ্রিয় ওয়েবসাইটই আছে।

top500.org এর সমীক্ষা অনুসারে পৃথিবীর দ্রুতগতির ৫০০ সুপার কম্পিউটারে লিনাক্স ব্যবহার করা হয় যার তালিকা https://www.top500.org/lists/top500/2020/11 লিংকে গেলেই দেখতে পাবেন।

alexa.com এর তথ্য বিশ্লেষণ অনুসারে পৃথিবীর টপ ১ মিলিয়ন সার্ভারের ৯৬.৩% সার্ভার লিনাক্সে চলে।

US মিলিটারি ২০০৭ সাল থেকে লিনাক্সে মাইগ্রেট করেছে এর উচ্চ সিকিউরিটির জন্য। তথ্যসূত্রঃ https://www.linux.com/news/open-technology-within-dod-intel-systems/

এই তালিকা আরো অনেক অনেক বড় করা যেতে পারে। এতসব সমীক্ষার কথা শুনে হয়ত চোখ ছানাবড়া হয়ে যাচ্ছে কিন্তু আরো জেনে অবাক হবেন আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহার করা এন্ড্রয়েড ফোন লিনাক্সের একটি ডিস্ট্রিবিউশন মাত্র। লিনাক্স কার্নেলের উপরেই বানানো এই অপারেটিং সিস্টেম। তাছাড়া চীন, রাশিয়া, তুর্কি, আমেরিকাসহ অনেক পরাশক্তির দেশের সরকার কিন্তু লিনাক্স ব্যবহার করে।
লিনাস টরভাল্ডস: লিনাক্সের পেছনের মহারথী 2

লিনাক্স কি?
এতক্ষণ ধরে আমরা লিনাক্সের গুনগানই শুনে গেলাম। এখন আমরা খানিকটা আনুষ্ঠানিকভাবে পরিচিত হই লিনাক্সের সাথে। তো আসলে লিনাক্স কি?
সঠিকভাবে বলতে গেলে লিনাক্স কিন্তু একটি পূর্ণাঙ্গ অপারেটিং সিস্টেম না, লিনাক্স হচ্ছে একটি অপারেটিং সিস্টেম কার্নেল। কার্নেল হল অপারেটিং সিস্টেমের একদম মূল কাঠামোগত অংশ যার উপরে বাকি সব উপরের স্তরের ফাংশনালিটি এবং দৃশ্যমান অংশ (GUI) বসিয়ে বানানো হয় অপারেটিং সিস্টেম।

তো লিনাক্স কার্নেল এত জনপ্রিয় কেন? লিনাক্সের জনপ্রিয়তার মূল একটি কারণ হল এটি একটি Open Source Software. প্রথমেই বলে রাখি ওপেন সোর্স মানেই কিন্তু ফ্রি বোঝায় না। একটি সফটওয়্যার ওপেন সোর্স বলতে বোঝায় এর সোর্সকোড উম্মুক্ত এবং এটাকে অন্যকেউ বর্ধিত বা পরিমার্জিত করে যেকোন কিছু তৈরির লাইসেন্স রাখে যা Cloused Source সফটওয়্যার যেমন উইন্ডোজে সম্ভব না। উইন্ডোজ কখনোই আপনাকে তাদের সোর্স কোড দিয়ে দেবে না। অপরদিকে লিনাক্স কিন্তু শুধুই ওপেন সোর্স নয় এটি ফ্রিও। আপনি নিজেও চাইলে এর সোর্স কোড বদলে নিজের মত তৈরি করে নিতে পারেন নিজের ডিস্ট্রিবিউশন। ওপেন সোর্স হওয়ার কারণে বর্তমানে প্রায় ছয়শোটির মত লিনাক্স ডিস্ট্রিবিউশন আছে এবং আরো পাঁচশো ডিস্ট্রিবিউশন নিয়ে কাজ চলমান। এ সকল ডিস্ট্রিবিউশনের মাঝে Ubuntu, Fedora, Arch Linux, Kubuntu, Kali বেশ প্রসিদ্ধ। একেকটি ডিস্ট্রিবিউশন তৈরি একেক কাজের ধরনের কথা মাথায় রেখে। যেমন Ubuntu তৈরি করা হয়েছে সাধারণ ইউজারদের কথা চিন্তা করে যেখানে Kali Linux তৈরি করা হয়েছে সিকিউরিটি এবং পেনিট্রেশন টেস্টিং এর কথা মাথায় রেখে।

এই বহুলব্যবহৃত অপারেটিং সিস্টেম কার্নেলের জনক লাইনাস ১৯৬৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন ফিনল্যান্ডের এক সুইডিশভাষী পরিবারে। তার বাবা (নিলস টরভল্ডস) Nils Torvalds একজন প্রসিদ্ধ রাজনীতিবিদ। মাত্র ১১ বছর বয়সে প্রথম কম্পিউটারের সান্নিধ্যে আসেন প্রসিদ্ধ পরিসংখ্যানবিদ ও গণিতবিদ পিতামহের আনা IBM এর Commodore vic 20 মডেলের মাধ্যমে। পিতামহকে BASIC প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজে সাহায্য করতেই কম্পিউটারের সাথে প্রথম পরিচয়। এরপর থেকে কম্পিউটার নামক ভাইরাস টরভাল্ডকে কখনো পিছু ছাড়েনি।

পরবর্তীতে লাইনাস University of Helsinki তে পড়ালেখা শুরু করার কিছুকাল পরেই নিজেকে সেই ঐতিহাসিক প্রজেক্টের জন্য নিয়োজিত করেন যার মাহাত্ম্য হয়ত তখন তিনি নিজেও ভাবেননি। তৎকালীন সময়ে Unix অপারেটিং সিস্টেম বেশ জনপ্রিয় ছিল যার খরচ বহন করা সাধারণ কারো জন্য এক প্রকার অসম্ভবই ছিল। মূলত বিশাল সব কর্পোরেট কোম্পানিরাই তখন এই অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করতো। টরভাল্ডস নিজেই এই অপারেটিং সিস্টেম কেনার সামর্থ্য রাখতেন না, মূলত এই কারণেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন ফ্রি অপারেটিং সিস্টেম বানানোর, যার জন্য মূলত দরকার কার্নেল। এই অনুপ্রেরণা থেকেই পরে তিনি এই প্রজেক্টে অনবরত কাজ করে যান।
লিনাস টরভাল্ডস: লিনাক্সের পেছনের মহারথী 3
“Linux: A Portable Operating System” এটা ছিল তার Mscর থিসিস সাব্জেক্ট। তার অগাধ শ্রমের ফলস্বরূপ লাইনাস ১৯৯১ সালে লিনাক্স কার্নেল প্রথমদিককার ভারশন ডেভেলপ করেন। যা পরিপূর্ণভাবে সংস্কার করে রিলিজ করেন ১৯৯৪ সালে। ১৯৯১ সালের ভারশনে মাত্র দশ হাজার লাইন কোড ছিল। যা ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে দাঁড়িয়েছে ২৭.৮ মিলিয়ন লাইনের কোডে! ওপেন সোর্স প্রজেক্ট হিসেবে এই কোডবেইসে এখন পুরোপৃথিবীর অনেকেই কন্ট্রিবিউট করে যাচ্ছেন। আপনিও চাইলে এই কোডবেইসে অবদান রাখতে পারেন যথাযথভাবে! এই কোডবেইস এখনো লাইনাস নিজেই মেন্টেইন করে যাচ্ছেন। তার গিটহাব একাউন্টে গেলে প্রতিদিনই তার কোন না কোন নতুন কমিট দেখতে পাওয়া যায় এখনো!

লাইনাসের অবদান কেবল লিনাক্সেই সীমাবদ্ধ নয়, তিনি ২০০৫ সালে লিনাক্সের ভারশন কন্ট্রোলের জন্য জনপ্রিয় ডিস্ট্রিবিউটেড ভারশন কন্ট্রোল সিস্টেম GIT তৈরি করেন যা এখন সারাবিশ্বে জনপ্রিয়। প্রায় সকল প্রযুক্তি কোম্পানী পুরান সময়কার ভারশন কন্ট্রোল সিস্টেম Subversion থেকে GIT এর দিকে সরে এসেছে। তিনি ওপেন সোর্স রেভ্যুলুশনের অন্যতম একজন পথিকৃত। তার পথ অনুসরণ করে অনেক বড় বড় সফটয়্যারও ওপেন সোর্সিং এর দিকে ঝুকছে যা প্রযুক্তি উৎকর্ষতা বাড়িয়ে দিচ্ছি বহুগুণ!

লিনাক্সের ডেভেলপমেন্ট এবং প্রসারনের জন্য ২০১৮ সালে তিনি IEEE Masaru Ibuka Consumer Electronics Award এ ভূষিত হন। এ ছাড়া ২০১৪ সালে IEEE Computer Pioneer Award পান কম্পিটার ইন্ডাস্ট্রিতে তার অবদানের জন্য। এছাড়া কম্পিউটার বিজ্ঞানে অবদানের পেয়েছেন আরো অগণিত সব সম্মাননা।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, প্রযুক্তি জগতে এত অবদানের পরেও আমাদের প্রজন্মের অধিকাংশই আমরা লাইনাসকে নিয়ে কিছুই জানিনা। হয়ত জানবো কোন একদিন তার মৃত্যুর পরে ঠিক যেমনটা আমরা জেনেছি স্টিভ জবস সহ অনেকের ক্ষেত্রে। লিনাক্স আর লাইনাসকে বিস্তারিত লিখতে গেলে হয়ত কলমের কালি ফুরিয়েই যাবে। তবে এতটুকু বলতে পারি আপনার প্রতিটি ফেইসবুক পোস্ট , প্রতিটি দেখা ইউটিউব ভিডিও কিংবা করা প্রতিটি গুগল সার্চ প্রতিটির পেছনে রয়েছে লিনাক্স আর লাইনাসের অবদান। আসুন নতুন প্রজন্মের সবাইকে পরিচিয় করিয়ে দেই এই মহারথীর সাথে।

লেখক: সাকিব আবরার, কম্পিউটার সাইয়েন্স অ্যান্ড ইলেকট্রনিক (সিএসই) বিভাগ, চতুর্থ বর্ষ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!