লালসবুজ পতাকা হাতে দুঃসাহসী নারী পরিব্রাজকের মুঠোয় ১৪৪ দেশ

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের মুখোমুখি

এখন তিনি সবচেয়ে বেশি দেশ ভ্রমণকারী প্রথম বাংলাদেশি মুসলিম নারী। একে একে ভ্রমণ করেছেন ১৪৪টি দেশ। বাংলাদেশের পতাকাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন সেসব দেশের স্কুল ও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে। মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে দেখেছেন বেড়াতে যাওয়া নতুন দেশের সৌন্দর্য্য— নদী, পাহাড়, পর্বত। মানুষের অধিকার আদায়ে তুলেছেন আওয়াজ। আর তিনি হলেন নাজমুন নাহার। বাংলাদেশের পতাকা হাতে এই নারী ১৪৪টি দেশ ভ্রমণের ঐতিহাসিক রেকর্ড অর্জন করেন মালদ্বীপে।

জন্ম তার লক্ষ্মীপুর সদরে। স্কুল-কলেজও সেখানেই। কলেজে পড়ার সময় যোগ দেন গালর্স গাইডে। সেখান থেকেই শুরু ভ্রমণের নেশা। কৌতূহলী চোখ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর গার্লস গাইডের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। অনার্স প্রথম বর্ষেই বেড়াতে যান ভারত। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালেই নেপাল ও সিঙ্গাপুর ভ্রমণ। পাস করার পর শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে পড়তে চলে যান সুইডেন। পড়ার পাশাপাশি খণ্ডকালীন কাজ করে টাকা জমাতেন। সেই টাকায় আবার বিদেশ ভ্রমণ।

চট্টগ্রাম প্রতিদিন কার্যালয়ে একান্ত আলাপচারিতায় নাজমুন নাহার জানালেন তার অভিজ্ঞতা, অর্জন ও স্বপ্নের কথা— যিনি কিনা বিশ্বভ্রমণের সময় মৃত্যুর হাতছানি থেকে ফিরে এসেছেন বহুবার।

লালসবুজ পতাকা হাতে দুঃসাহসী নারী পরিব্রাজকের মুঠোয় ১৪৪ দেশ 1

নাজমুন শুধু কোনো একটা দেশের শহর ঘুরেই ফিরে আসেননি। তিনি উঠেছেন পেরুর রেইনবো সামিটের মত পৃথিবীর বহু পর্বত সামিটে। যেখানে প্রচন্ড অল্টিচুডের কারণে মৃত্যুমুখে পড়েও আবার ফিরে এসেছেন মৃত্যুমুখ থেকে। ১০০ বছরে বৃষ্টি হয়নি যেখানে— চিলির সেই আতাকামার মতো আশ্চর্যজনক জায়গাতেও পা পড়েছে নাজমুন নাহারের।

আফ্রিকার গিনি কোনাক্রিতে ২৬ ঘণ্টা জঙ্গলে আটকা পড়েছেন রাতের অন্ধকারে। জর্জিয়ার সনেটি প্রদেশ যাওয়ার সময় পথে গুলির মুখোমুখি হয়ে পাহাড়ে চুপ মেরে শুয়েছিলেন চার চার ঘন্টা। সাহারা মরুভূমিতে ভয়ঙ্কর মরুঝড়ের মুখোমুখি হয়েছেন। গুয়াতেমালায় ছিনতাইকারীর গুলি আর চুরির মুখোমুখি হয়েও ফিরে এসেছেন কৌশলে। শুধু কি তাই? তিনি কিরগিস্তানের আলা আরচা পর্বত সামিটে ওঠার সময় পা পিছলে পড়ে ছোট্ট একটা বুনো গাছের সাথে ঝুলে ছিলেন। উঁচু পর্বত থেকে ঝুলে যাওয়া শরীরের নিচে ছিল গহীন ফাঁকা— যেখানে বাঁচার কোন উপায় ছিল না। কিন্তু সেখান থেকেও বেঁচে ফিরেছেন সহঅভিযাত্রীদের সহযোগিতায়।

লালসবুজ পতাকা হাতে দুঃসাহসী নারী পরিব্রাজকের মুঠোয় ১৪৪ দেশ 2

নিজের জীবনের কাহিনী বলতে গিয়ে নাজমুন জানান, ছোটবেলা থেকেই তার মন ছিল জিজ্ঞাসু। বাবা ছিলেন অন্যরকম ভালো মনের মানুষ। শুধু কি বাবা? তার দাদাও ঘুরে বেড়িয়েছেন আরবের অনেক দেশ। তবে বাবাই তাকে শিখিয়েছেন অন্ধকারের পথ মাড়িয়ে সামনে যেতে। স্বপ্নকে জাগিয়ে রাখার কথা সব সময় বলতেন বাবা। নাজমুন নাহার বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই বই পড়তাম। সবসময় মন বলত, দেখতে চাই সীমানার বাইরে কি আছে? বাবাই আমাকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন।’

সর্বাধিক রাষ্ট্র ভ্রমণকারী প্রথম বাংলাদেশি মুসলিম নারী তিনি। তার সাম্প্রতিক অভিযাত্রায় সফর করেছেন লোহিত সাগরের পার্শ্ববর্তী আফ্রিকা মহাদেশের দেশ জিবুতি, সোমালিল্যান্ড, সুদান পর্যন্ত। এরপর তিনি ভারতীয় মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ ভ্রমণে যান।

ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে নাজমুন নাহার জানান, লোহিত সাগরের পাড় ঘেঁষে জিবুতি থেকে সোমালিল্যান্ডে সড়ক পথে ১৮ ঘন্টা অভিযাত্রা করেন। জিবুতি থেকে সোমালিল্যান্ডে যাওয়ার পথে কোনো রাস্তা ছিল না। পথহীন পথে তার এই অভিযাত্রা ছিলো ভয়ঙ্কর ও কঠিন। জিবুতির সীমান্ত অতিক্রম করে লোয়াদা, সায়লাক, আশাদ্দো, জিধি, ক্যাবদুলকাদির, হরিদ, কুলজিদ, বোরাম, গোরোইও, গ্যাবেলে, আরবসিও হয়ে সোমালিল্যান্ডের রাজধানী হারেগেয়েইসা পৌঁছান। তারপর সুদানের উদ্দেশ্যে যাত্রা।

লালসবুজ পতাকা হাতে দুঃসাহসী নারী পরিব্রাজকের মুঠোয় ১৪৪ দেশ 3

৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশের পতাকা হাতে নাজমুন নাহার পৌঁছেন মালদ্বীপের মালাহিনী কুদা ব্যান্ডোস দ্বীপে। মালদ্বীপের পর্যটন মন্ত্রী ড. আব্দুল্লাহ মাসুমের নেতৃত্বে নাজমুন নাহারের ১৪৪ দেশ ভ্রমণের বিশ্বরেকর্ডকে রাষ্ট্রীয়ভাবে অভিনন্দন জানানো হয় মালদ্বীপ সরকারের পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে। মালদ্বীপের পর্যটনমন্ত্রী ডক্টর আব্দুল্লাহ মাসুম তাকে ‘বিশ্ব নারীদের এক সাহসী প্রতীক’ বলে অভিহিত করেন।

নাজমুন নাহার মনে করেন, পৃথিবীতে করোনাকালীন এই কঠিন চ্যালেঞ্জের মাঝে তার এই অভিযাত্রা অত্যন্ত কঠিন হলেও তিনি সকল কঠিনকে অতিক্রম করে করে মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় নিয়ে বাংলাদেশের লালসবুজের পতাকাকে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বব্যাপী। পৃথিবীর পথে পথে তার বেশিরভাগই অভিযাত্রা ছিল সড়কপথে একাকী।

বাংলাদেশের পতাকাবাহী এই বিশ্ব অভিযাত্রী শুধু বাংলাদেশ নন, পৃথিবীব্যাপি অনেক তরুণের আইকন। চলতি বছরের ৩ ডিসেম্বর সোমালিল্যান্ডের জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিক ‘গেসকা আফ্রিকা’র প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয় বিশ্বজুড়ে নাজমুনের দেশভ্রমণের দুঃসাহসিক অভিযাত্রার কথা। ২৭ নভেম্বর জিবুতির একমাত্র রাষ্ট্রীয় পত্রিকা ‘লা নেশন’-এর পাতা জুড়ে বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকার ছবিসহ তাকে নিয়ে বের হয় বিশেষ প্রচ্ছদ প্রতিবেদন। সোমালিল্যান্ডের সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় উঠেছে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে। সেখানকার বুদ্ধিজীবী রাজনীতিবিদ লেখকরা তাকে অভিনন্দন জানান ভিন্নভাবে। বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ও পিস অ্যাক্টিভিস্ট সাহারা হালগেন এবং হারগেইসা কালচারাল সেন্টার তাকে সংবর্ধনা দেয়। শুধু তাই নয় তিনি যখন সুদান অভিযাত্রা করেন, সেখানকার বিখ্যাত রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ হামদ সায়েদসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব তাকে অভিনন্দিত করেন। এভাবে নাজমুনের মাধ্যমে লাল-সবুজের পতাকার জয় ছড়িয়ে পড়েছে পুরো পৃথিবীতে।

ভ্রমণের সময় সোমালিল্যান্ডের ভাঙ্গা রাস্তা, মরু প্রান্তর, গাড়ি নষ্ট হয়ে আটকে যাওয়া, বন্যপ্রাণীর জঙ্গল ভেদ করে রাজধানী হারগেইসা পর্যন্ত যাত্রা করতে ভয় পাননি তিনি। তারপর উত্তর সুদানের খার্তুমসহ আফ্রিকার বিভিন্ন স্থানে সফর করেন এবং তিনি মালদ্বীপের মালাহিনি দ্বীপে ৭ দিনের এক রোমাঞ্চকর অভিযাত্রা শেষে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরার পর অবিন্তা ফাউন্ডেশন স্কুল তাকে সংবর্ধনা দেয়। সেখানে তার বিশ্বভ্রমণের ভিডিওচিত্র প্রদর্শিত হয়। অবিন্তা স্কুলের শিশুদের সাথে তিনি তার বিশ্ব ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।

স্মৃতি হাতড়ে নাজমুন জানান, ২০০০ সালে প্রথম ভারত দিয়ে শুরু হয় তার পৃথিবী ভ্রমণ। ২০ বছর তিনি পৃথিবীর পথে পথে অভিযাত্রা করেছেন বাংলাদেশের পতাকাকে বিশ্ব দরবারে সর্বোচ্চ উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। সম্পূর্ণ ভ্রমণই ছিল একা একা। শুধু ১৪টি দেশে ভ্রমণের সঙ্গী ছিলেন তার মা।

লাল-সবুজের পতাকাবাহী এই পরিব্রাজকের স্বপ্ন, তিনি পা রাখবেন পৃথিবীর প্রতিটি দেশে। পৃথিবীর ইতিহাসে যে সকল নারীরা বাধা ডিঙিয়ে বেরিয়ে আসার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সর্বাধিক দেশ ভ্রমণকারী প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে তার নামই প্রথম আসে। শুধু তাই নয়, তিনি বহু সম্মাননা উপাধিতেও ভূষিত হয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পেয়েছেন পিচ টর্চ বিয়ারার এওয়ার্ড, আর্থ কুইন এওয়ার্ড, জাম্বিয়া সরকারের গভর্নরের কাছ থেকে পেয়েছেন ফ্ল্যাগ গার্ল উপাধি, অনন্যা শীর্ষ দশ আওয়ার্ড, জোনটা ইন্টারন্যাশনাল দিয়েছে গেম চেঞ্জার অব বাংলাদেশ এওয়ার্ড, অতীশ দীপঙ্কর গোল্ড মেডেল এওয়ার্ডসহ আরও নানা সম্মাননা।

নাজমুন নাহার উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটি থেকে‌। এছাড়াও তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে হিউম্যান রাইটস ও এশিয়া বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন।

পৃথিবী ভ্রমণ করতে গিয়ে বহু কঠিন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন নাজমুন। ইথিওপিয়ার জঙ্গলে হামার আদিবাসীদের সাথে গরুর কাঁচা মাংস খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে। আফ্রিকাতে তিন মাস ধরে খেতে হয়েছিল আলু। সর্বোচ্চ আড়াই দিন না খেয়ে থাকার রেকর্ডও আছে তার। পথে গাছ থেকে গাছের সাদা অরেঞ্জ খেয়ে দুইদিন পর আফ্রিকাতে পানির পিপাসা মিটিয়েছেন।

নাজমুন নাহার পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশ ভ্রমণ করেছেন সড়কপথে— একটা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত দেখার জন্য। কম খরচে পৃথিবী ঘোরার জন্য তিনি সড়কপথকেই ভ্রমণের উপায় বেছে নিয়েছেন। ছোটবেলা থেকে তিনি ম্যাপের ওপর রিসার্চ করেছেন কিভাবে কম খরচে ভ্রমণ করা যায় সেটা বোঝার জন্য।

ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে নাজমুন আরও জানান, যেহেতু তিনি সড়কপথে ভ্রমণ করেছেন দিনের পর দিন। সর্বোচ্চ টানা ৫৮ ঘন্টা বাসে, কখনো ৪৮ ঘন্টা, কখনো বা ৩৬ ঘন্টা তাকে বাসে জার্নি করতে হয়েছে এক দেশ থেকে আরেক দেশে। এটা ভাবলে অবাক লাগে যখন টানা কখনো ১৫ দেশ, কখনো ১৪ দেশ, কখনো ১৪ দেশ এভাবে তিনি তিন থেকে পাঁচ মাসের জন্য সড়কপথে এক শহর থেকে আরেক শহরে এক দেশ থেকে আরেক দেশে ভ্রমণ করেছেন।

পৃথিবীর ১৪৪টি দেশ ঘুরে নাজমুনের মনে হয়েছে পৃথিবী একটা বাড়ি। ভ্রমণের মধ্যে নাজমুন নাহারের সবচেয়ে পছন্দের দেশ আইসল্যান্ড।

নাজমুন নাহারের সম্মানে শুক্রবার (১ জানুয়ারি) বিকেল ৪টায় চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক সংগঠন স্বপ্নযাত্রীর আয়োজনে চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির গ্যালারি হলে অনুষ্ঠিত হবে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, কবি ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক ড. মোহীত উল আলম।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!