লাগেজে চট্টগ্রামে বিশেষ পণ্য আনেন অর্ধশত ভারতীয় দম্পতি, পর্যটকের বেশ

বাংলাদেশে ঢোকার পথ হিসেবে আখাউড়া স্থলবন্দর বিশেষ পছন্দ

ভারত থেকে লাগেজ পার্টির পণ্য অভিনব কৌশলে চট্টগ্রামে আসছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে। এভাবে আসছে পোশাক ও কসমেটিকসসহ বিভিন্ন পণ্য। অর্ধশতাধিক ভারতীয় দম্পতি পর্যটকের বেশে এভাবে পণ্য নিয়ে আসাকে বেছে নিয়েছেন পেশা হিসেবে। এভাবে প্রতিদিন ভারত থেকে পণ্যবাহী তিন শতাধিক লাগেজ চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে।

বৃহস্পতিবার (১৭ মার্চ) আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে ভারতীয় এক দম্পতি বিপুল পরিমাণ পোশাক নিয়ে আসার সময় কাস্টমসের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েন। পরে ওই দম্পতি স্বীকার করেন, তারা শুধু পণ্য বহন করেন। এর আগে আর কখনও বাংলাদেশে আসেননি। ভারত থেকে আসার সময় তাদের শুধু চট্টগ্রামের একটি নির্দিষ্ট ঠিকানায় যেতে বলা হয়েছে। এর বাইরে তারা কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে ‘লাগেজ পার্টির’ মাধ্যমে অবৈধভাবে নানা ধরনের পণ্য আনা হচ্ছে বহুদিন ধরেই। বৃহস্পতিবার (১৭ মার্চ) ভারতীয় এক দম্পতির এমনই এক লাগেজ পার্টির একটি চালান আটক করার পর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ একপর্যায়ে ছেড়ে দেওয়ারও চেষ্টা করে। পরে স্থানীয় সাংবাদিকরা চ্যালেঞ্জ করলে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ খানিকটা পিছু হটে। তবে এরপরও শেষ পর্যন্ত অনেক গড়িমসির পর তারা নামমাত্র শুল্ক নিয়ে পণ্য বহনকারী ‘লাগেজ পার্টি’কে ছেড়ে দেয়।

ব্যাগেজ সুবিধার বাইরে পৌনে ছয় লাখ টাকার পণ্য আনার কথা উল্লেখ করে ৮৩ হাজার টাকা শুল্ক নিয়ে ওই ‘লাগেজ পার্টি’কে ছেড়ে দেওয়া হয়।

জানা গেছে, ভারতীয় ওই দম্পতি বিশেষ ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে বাংলাদেশে ঢোকেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি এসব পণ্য ব্যবসার জন্যই আনা হয়েছে বলে স্বীকার করেন। তবে পণ্যের মালিক তিনি নন বলে জানান। পণ্যগুলো চট্টগ্রামে নিয়ে আসা হচ্ছিল বলে ওই ব্যক্তি জানান।

যাত্রীদের ব্যাগেজ সুবিধার আওতায় উল্লেখ আছে, বিদেশফেরত যাত্রী যুক্তিসঙ্গত পরিমাণে খাদ্যদ্রব্য, পরিধেয় গৃহস্থালি বা অন্যবিধ সামগ্রী ১৫ কেজি নিতে পারবেন। এর বেশি হলে তাকে নিয়ম অনুসারে শুল্ক সুবিধা দিতে হবে। এক বছরে এভাবে তিনবার ৪০০ ডলার পর্যন্ত দামের পণ্য নিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, বৃহস্পতিবার (১৭ মার্চ) সকালে ধনঞ্জয় দে ও রূপা দে নামে দুই ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশে ঢোকেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে। তাদের কাছে বড় আকারের পাঁচটি ব্যাগ ছিল। স্থানীয় এক ব্যবসায়ী বিষয়টি গোপনে কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে জানান। প্রথমে গড়িমসি করলেও একপর্যায়ে ব্যাগে কী আছে জানতে চাওয়া হয় ওই দুই ভারতীয় নাগরিকের কাছে। এরই মধ্যে তাদের ব্যাগ যেন তল্লাশি না করা হয়, সে জন্য ছুটে আসেন একটি জাতীয় দৈনিক ও বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিক। সামান্য জরিমানা করা হবে— এই শর্তে ধনঞ্জয়কে দিয়ে ওই সাংবাদিকের সামনে ব্যাগ খোলান কাস্টমস কর্মকর্তারা। এরই মধ্যে আরও কয়েকজন সাংবাদিক ঘটনার বিষয়ে জেনে কাস্টমস কার্যালয়ে উপস্থিত হন।

তবে ওই সাংবাদিকরা যাওয়ার পরই কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা জহিরুল হক লাগেজ পার্টির পক্ষ নিয়ে যুক্তি দেখান— একেকজন যাত্রী ৪০০ ডলারের সমপরিমাণ পণ্য কিংবা ১৫ কেজি ওজন পর্যন্ত পণ্য নিতে পারবেন। সেই হিসেবে অতিরিক্ত ৬৫টি থ্রিপিস ধনঞ্জয় দে ও রূপা দে নামে দুই ভারতীয় নাগরিকের বহন করা লাগেজে পাওয়া গেছে বলে জানান তিনি। সাংবাদিকরা এ নিয়ে আপত্তি তুললে তড়িঘড়ি করে আবার ধনঞ্জয়কে দিয়েই ব্যাগের কাপড় গণনা শুরু করান। তখন তিনি মোট ৯৯টি পোশাক অতিরিক্ত এনেছেন বলে স্বীকার করেন। উপস্থিত সাংবাদিকদের চ্যালেঞ্জের মুখে এরপর পাঁচটি ব্যাগ খুলে মোট ২৯৪টি পোশাক পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৭০টি থ্রিপিস, ২০৬টি টি-শার্ট এবং ১৮টি জিন্স প্যান্ট রয়েছে। অন্যদিকে ব্যাগে পাওয়া যায় একাধিক মদের বোতলও।

জানা যায়, দেশে করোনাভাইরাস হানা দেওয়ার পর থেকে ভারত থেকে এভাবে অভিনব কৌশলে পণ্য আসা শুরু হয়। সাম্প্রতিক সময়ে এর মাত্রা বেড়ে গেছে। বিশেষ করে কলকাতা থেকে পোশাকসহ কসমেটিকস দেশে ঢুকছে অভিনব সব কৌশলে। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় ব্যবসায়ীরাই লোক দিয়ে এসব পণ্য বাংলাদেশে পাঠান। কাস্টমসসহ স্থলবন্দরের সংশ্লিষ্টদেরকে ম্যানেজ করে তারা অবাধে এসব পণ্য নিয়ে যাচ্ছেন। এরপর পণ্যগুলো চট্টগ্রাম, ঢাকা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় চলে যায়। অর্ধশতাধিক ভারতীয় দম্পতি ‘লাগেজ পার্টি’র এ পেশায় জড়িয়ে পড়েছেন বলে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্থানীয় চার-পাঁচজন সাংবাদিক এর সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে বন্দর এলাকার এক সাংবাদিক সরাসরি এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তার শ্বশুরবাড়ি চট্টগ্রামে হওয়ায় নিয়মিতই পোশাক-জাতীয়পণ্য চট্টগ্রামে পাঠান তিনি।

লাগেজ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ভারতীয় নাগরিক ধনঞ্জয় দে স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, ‘ব্যবসার জন্যই এসব পণ্য দেওয়া হয়েছে। আমি শুধু পণ্য বহন করি। এর আগে আর কখনও বাংলাদেশে আসিনি। আমাকে চট্টগ্রাম যেতে বলা হয়েছে। এর বাইরে আমি কিছুই জানি না।’

অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার ছবি আপনারা কোথাও দেবেন না। তাহলে মুখ দেখাতে পারব না।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!