লাইব্রেরি মানে বইয়ের আনন্দভুবন, জ্ঞানের বাতিঘর

মনকে সতেজ ও প্রসারিত করে জীবনকে সুন্দররূপে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন জ্ঞান। আর জ্ঞান অর্জনের জন্য পাঠচর্চা একান্ত আবশ্যক। বই পড়া ছাড়া নিজেকে জানা বা জ্ঞান অর্জন করার অন্য কোন উপায় নেই।

ধর্মের র্চচা মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা ও গির্জার বাইরেও করা চলে। দর্শনের চর্চা গুহায়, নীতির চর্চা ঘরে এবং বিজ্ঞানের চর্চা জাদুঘরে রোগের চিকিৎসা হাসপাতালে হয়। কিন্তু মানুষের মানসিক উৎকর্ষতা, কাজকর্মে সচ্ছতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা, উন্নত জীবনযাপন— সর্বোপরি নিজেকে জানার জন্য চাই লাইব্রেরি। কারণ লাইব্রেরিতে বিন্যস্ত থাকে মানবসভ্যতার হাজার বছরের ইতিহাস। প্রাচীন শিলালিপি থেকে আধুনিক লিপির গ্রন্থিক স্থান লাইব্রেরি।

একটি লাইব্রেরি। মানব জীবনকে যেমন পাল্টে দেয় তেমনি আত্মার খোরাকও যোগায়। লাইব্রেরি হল শ্রেষ্ঠ আত্মীয়— যার সাথে সবসময় ভালো সম্পর্ক থাকে। লাইব্রেরি মনের হাসপাতাল। তাই লাইব্রেরির প্রয়োজনীয়তা হাসপাতালের চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। দেহের পুষ্টির জন্য যেমন খাদ্যের প্রয়োজন তেমনি মনের স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন মানসিক খাদ্যের। মানসিক খাদ্য মানে বইপড়া আর বই পড়ার জন্য প্রয়োজন বই পড়ার ও সংগ্রহ রাখার ঘর অর্থাৎ লাইব্রেরি।

আমাদের দেশে শিক্ষাব্যবস্থায় স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের সুনির্দিষ্ট সিলেবাসে গুটিকয়েক পাঠ্যপুস্তক পড়িয়ে শিক্ষকগণ তাঁদের দায়িত্ব সম্পন্ন করেন এবং ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষার প্রয়োজনে গুরুপ্রদত্ত কতিপয় নোট মুখস্থ করে তা পরীক্ষার খাতায় উদগীরণ করে সাফল্য লাভ করে। এতে শিক্ষার্থীরা প্রকৃত জ্ঞান অর্জনে ব্যর্থ হয়। শিক্ষার্থীদের পাঠের স্বাধীনতা ও স্বাধীন চিন্তার অবকাশ স্কুল-কলেজে নেই। মূলত শিক্ষার্থীদের পাঠের স্বাধীনতা ঘাটতি পূরণের জন্য স্বাধীনভাবে বই পড়া একান্ত প্রয়োজন। আর স্বাধীনভাবে বইপড়ার জন্য প্রয়োজন লাইব্রেরি।

বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের জ্ঞানের যে অপূর্ণতা রয়েছে একমাত্র লাইব্রেরিই তা পূরণ করতে পারে। এ জন্য গ্রামে গ্রামে, নগরে নগরে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা অতীব জরুরি। শুধু শিক্ষার্থীরা নয়, লাইব্রেরির সান্নিধ্য সর্বস্তরে গতিশীলতা বহুগুণে বৃদ্ধি করে। লাইব্রেরি হলো গণমানুষের বিশ্ববিদ্যালয়। লাইব্রেরির প্রতিটি বই অতীতের অভিজ্ঞতা ও উপলিদ্ধ থেকে সঠিকপথ ও বিশুদ্ধ চিন্তার সাহায্যে জীবনের সঠিক পথ দেখিয়ে দেয়। বই পড়া মানে সভ্যতার শ্রেষ্ট ও মহা মানবদেরকে জানা এবং তাদের বর্নাঢ্য কর্মময় অতীতকে মনের চোখে দেখা। মনের দৃষ্টিশক্তির সবচেয়ে বড় সম্পদ— বিশুদ্ধ চিন্তার বিশুদ্ধ আত্মা। একথা সত্যি যে, মনের অন্ধত্বের চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য জীবন আর কিছু নেই। একজন অন্ধলোক যেমন প্রকৃতির সৌন্দর্য্য দেখতে পায়না তেমনি বই ছাড়া চিরজীবী মহৎ ব্যক্তিদের সান্নিধ্য লাভ করা যায় না। কারণ যুগযুগ ধরে সফল মানুষের সর্বোত্তম চিন্তা ভাবনা, ধ্যানধারণা বইয়ে সংগৃহীত হয়ে আসছে।

মূলত বই মানুষের মনকে বিকাশ, উজ্জীবন, উত্তোরণ পরিশীলিত ও মনকে উদার করে তুলে। আবার বই এক একটি মহৎ ব্যক্তির জীবনী অর্থাৎ মহৎ মানব জীবনের বাস্তব ঘটনার কাহিনী। মহৎ ব্যক্তির জীবনীতে ব্যক্তিত্বের বিশ্লেষণ, জন্ম, শিক্ষা, কাজ ও জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাসমুহ জানা যায়। তাই প্রত্যেক মানুষের ভিতরেই যে একজন ভাল মানুষ লুকিয়ে রয়েছে, তা বই পড়ে জানতে হবে। মানুষ হবার জন্য বই পড়তে হবে, সুন্দরকে জন্য বই পড়তে হবে। বই পড়ার গুরুত্ব মনীষীদের উক্তি থেকে সহজেই বোঝা যায়।

স্পিনোজা বলেন, ‘ভাল খাদ্য বস্তু পেট ভরে কিন্তু ভাল বই মানুষের আত্মাকে পরিতৃপ্ত করে।’ দেকার্তে বলেন, ‘ভাল বই পড়া মানে গত শতাব্দীর সেরা মানুষদের সঙ্গে কথা বলা।’ ইউরোপকাঁপানো নেপোলিয়ান বলেন, ‘অন্তত ষাট হাজার বই সঙ্গে না থাকলে জীবন অচল।’ জন মেকলে বলেন, ‘প্রচুর বই নিয়ে গরিব হয়ে চিলেকোঠায় বসবাস করব তবু এমন রাজা হতে চাই না যে বই পড়তে ভালবাসে না।’ নর্মান মেলর বলেন, ‘আমি চাই যে বই পাঠরত অবস্থায় যেন আমার মৃত্যু হয়।’

আমাদের দেশে জাতীয় লাইব্রেরি, পাবলিক লাইব্রেরি, একাডেমিক লাইব্রেরি, বিশেষ লাইব্রেরি, ভ্রাম্যমান লাইব্রেরি, সামজিক লাইব্রেরি, ব্যক্তিগত লাইব্রেরিসহ বিভিন্ন লাইব্রেরির মাধ্যমে বই পড়ার সুযোগ রয়েছে। এসব লাইব্রেরি সামাজিক সংকটের উত্তরণ, শিক্ষার উন্নয়ন, চিন্তা চেতনার প্রতি ঐক্য, সংহতি ও আলোর পথ দেখিয়ে যাচ্ছেন। ব্যক্তি জীবনের মতো বইয়ের মূল্যও বড্ড বেশি বলে লাইব্রেরিকে উৎসব ও পাঠমুখী করা প্রয়োজন।

যুবসমাজ ও তরুণ প্রজন্মকে মাদকসহ বিভিন্ন অপরাধ থেকে মুক্ত রাখার জন্য বই পড়া ও খেলাধুলার বিকল্প নেই। তাই লাইব্রেরিকে পাঠমুখর করার লক্ষ্যে পাঠকদের জন্য চা-নাস্তার ব্যবস্থা, পাঠ অভিজ্ঞতা, অনুভূতি, উপলব্ধি ও মত বিনিময়ের লক্ষ্যে প্রতি সাপ্তাহে একটি করে ‘বইপাঠ-আড্ডা’র আয়োজন এবং প্রতি মাসে শিক্ষক ও সমাজের অলোকিত ব্যক্তিদের নিয়ে পাঠসমাবেশ ও বইপড়ুয়াদের মাঝে পুরস্কার প্রদানসহ বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে সর্বস্তরের মানুষকে বইমুখী করে তুলতে হবে। বইয়ের আলো ছাড়িয়ে পড়ুক সবখানে।

লেখক: সাহিত্য ও পাঠাগার সম্পাদক, কেসিদে ইনস্টিটিউট অফিসার্স ক্লাব, চট্টগ্রাম।

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!