লক্ষ শ্রমিককে দুর্ভোগে ফেলে ৪১২ কারখানা চালু হয়ে গেল চট্টগ্রামে
মর্জিনা বেগম। পেশায় পোশাকশ্রমিক। সাধারণ ছুটিতে বাড়ি গিয়েছিলেন। ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় তার বাড়ি। খবর পেলেন কারখানা খুলছে রোববার। এদিকে মহাসড়কে তো গাড়ি চলছে না। কিন্তু চাকরি তো বাঁচাতে হবে।
তাই শনিবার সকালে পায়ে হেঁটেই রওনা হলেন। কতটুকু পথ রিকশায়, আবার কতটুকু ভ্যানে চড়ে বিকেলের দিকে পৌঁছালেন চট্টগ্রামে— চকবাজার গণি কলোনির বাসায়।
রোববার সকাল ৬টা। মর্জিনা বেগমকে যেতে হবে চট্টগ্রাম ইপিজেডে— তার কর্মস্থলে। অন্যান্য সময় চকবাজার গোলজার মোড় থেকে কারখানা কর্তৃপক্ষের নির্ধারিত বাসে ১৪ কিলোমিটার দূরের কর্মস্থলে যান তিনি। কিন্তু রোববার তাকে পড়তে হয় মহাদুর্ভোগে। শহরের গণপরিবহন বন্ধ। না চলছে বাস, না চলছে লেগুনা বা টেম্পো। চকবাজার থেকে তাই ৬ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটেই তাকে যেতে হয়েছে দেওয়ানহাট। সেখান থেকে ভ্যানে চড়ে পৌঁছাতে হয়েছে ইপিজেড। কারখানায় যেতেই শুধু ভ্যান ভাড়া গুণতে হয়েছে ১০০ টাকা। বিকেলে ছুটির পরও একইভাবে কষ্ট পোহাতে হয়েছে তাকে ঘরে ফিরতে।
শুধু মর্জিনা বেগম নয়, রোববার থেকে খোলা থাকা কারখানাগুলোর প্রত্যেক শ্রমিকের দুর্ভোগের গল্প এমনই। চট্টগ্রামের তিনটি ইপিজেড, বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএর রপ্তানিমুখী ৪১২টি পোশাক কারখানা প্রায় ১ লক্ষ শ্রমিক কাজে যোগ দিলেন রোববার (২৬ এপ্রিল)। এর মধ্যে ২৫৫টি পোশাক কারখানা।
শিল্প পুলিশ জানিয়েছে, রোববার বিজিএমইএভুক্ত ৯২টি, সিইপিজেডের ৭৪টি, কর্ণফুলী ইপিজেডের ২৮টি, কোরিয়ান ইপিজেডের ২৫টি, বিকেএমইএর ৩১টি, বিটিএমইএ ৫টি এবং এর বাইরে ১৫৭টি কারখানাসহ আরএমজি (তৈরি পোশাক কারখানা) এবং নন-আরএমজি মিলিয়ে চট্টগ্রামে ৪১২টি কারখানা।
শ্রমিকদের আনা-নেওয়ার কাজে স্বাভাবিক সময়ে কারখানা কর্তৃপক্ষ বাসের ব্যবস্থা রাখেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সারা দেশে গণপরিবহন বন্ধ রেখেছে সরকার। চলছে সাধারণ ছুটিও। কিন্তু সাধারণ ছুটি জনসাধারণকে স্বস্তি দিলেও পোশাক শ্রমিকদের জন্য এ যেন ‘মরার ওপর খাঁড়ার ঘা।’
একদিকে তাদের অনেকে মার্চ মাসের বেতন পায়নি। কারও বকেয়া আরও বেশি। পেটে পর্যাপ্ত খাবার জোটেনি কারও। অন্যদিকে বাঁচাতে হবে চাকরি। এর মধ্যে বন্ধ গণপরিবহন। তাই পায়ে হেঁটে, ভ্যানে চড়ে যেভাবেই হোক কর্মস্থলে ছুটে আসতে হয়েছে পোশাক কারিগরদের।
আগ্রাবাদ এলাকায় পায়ে হেঁটে কর্মস্থলমুখী কয়েকজন পোশাক শ্রমিক বলেন, জরুরি প্রয়োজনে আমাদের কাজে যোগদান করতে বলা হয়েছে। করোনাভাইরাসের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে আমরাও সাড়া দিয়েছি। কিন্তু আমাদের যাতায়াতের বিষয়টিও জরুরি। আমরা তো কারখানার আশপাশে থাকতে পারছি না। আমাদের এভাবে অমানুষিক ভোগান্তিতে ফেলে দিয়ে তারা কেন কারখানা চালু করলেন?
তারা আরও বলেন, প্রশাসন ও মালিকপক্ষ চাইলে শ্রমিকদের জন্য পরিবহন সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে। শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত বাসগুলো শুধু সকাল ও বিকেলে চলাচলের ব্যবস্থা করা হোক। বলা হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানার ভেতরে আমাদের কাজ করানো হচ্ছে। দিনে দুইবার স্বাস্থ্যবিধি মেনেই আমাদের বাসে যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে সমস্যা তো নেই। ঝুঁকি কারখানাতে যেমন আছে, বাসেও একটু ঝুঁকি থাকবে।
কারখানা মালিকদের দাবি, যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে তারা কাজ শুরু করেছেন। তাদের বিদেশি ক্রেতাদের কার্যাদেশ রয়েছে। রপ্তানি অব্যাহত রাখার জন্য কারখানাগুলো চালু করতে হয়েছে তাদের।
বিজিএমইএ চট্টগ্রামের পরিচালক মোহাম্মদ আতিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘শিপমেন্ট থাকায় সীমিত পরিসরে কারখানা চালু করেছেন মালিকরা। সকল কারখানাকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারের স্বাস্থ্যবিধি মানার জন্য বিজিএমইএর পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কারখানায় মেশিনও দূরত্ব বজায় রেখে বসানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
চিটাগং এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনের (সিইপিজেড) মহাব্যবস্থাপক খুরশীদ আলম বলেন, ‘সিইপিজেডের ৭৪টি কারখানা রয়েছে। রোববার এসব কারখানার ২০ থেকে ২৫ শতাংশ শ্রমিক কাজে যোগ দিয়েছেন। সংখ্যা হিসেবে প্রায় ৪৫ হাজার শ্রমিক কাজে যোগ দিয়েছেন প্রথম দিন।’
কর্ণফুলী ইপিজেডের জেনারেল ম্যানেজার মশিউদ্দিন বিন মেজবাহ জানান, ‘কর্ণফুলী ইপিজেডের ২৫ থেকে ৩০টি কারখানা চালু হয়েছে। যেসব কারখানার কার্যাদেশ রয়েছে তারাই কারখানা চালু করেছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে তাদের বলা হয়েছে। প্রায় ২২ থেকে ২৫ হাজার শ্রমিক রোববার কাজে যোগ দিয়েছেন। এই ইপিজেডে মোট ৪১টি কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় ৮০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন।’
এএস/এমএফও