রোহিঙ্গা সমাবেশে মদদদাতারা চিহ্নিত, তালিকায় এনজিও ছাড়াও কয়েক ব্যক্তি

অবশেষে চিহিৃত করা হয়েছে কক্সবাজারের উখিয়া কুতুপালং ক্যাম্পে অনুমতি ছাড়া অনুষ্ঠিত রোহিঙ্গা সমাবেশের মদদদাতাদের। এরমধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের নামে গঠিত বেশ কয়েকটি সংগঠন এবং কয়েকটি এনজিও এবং বেশ কয়েকজন ব্যক্তি। আর এসব সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর কাছে লিখিত অনুরোধ জানানো হয়েছে।

এনজিও ব্যুরোর কাছে পাঠানো পত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে গঠিত ‘রোহিঙ্গা রিফিউজি কমিটি (আরআরসি), ভয়েস অব রোহিঙ্গা, আরকাইন রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউমিনিটি রাইটস (এআরএসপিএইচ) এবং এনজিও সংস্থা ‘এডিআরএ’ ও ‘আল মারকাজুল ইসলামী সংস্থা’ নামে দুটি এনজিও রোহিঙ্গা সমাবেশে টি-শার্ট ও ব্যানার সরবরাহ করেছে। রোহিঙ্গা সংগঠন ‘এআরএসপিএইচ’ এর উপদেষ্টা পরিষদে বাংলাদেশ সুপ্রীমকোর্টের এক আইনজীবীসহ কক্সবাজার দায়রা জজ আদালতের একজন পিপি, দুর্নীতি দমন কমিশনের পিপি ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক এবং ক্যাম্পে কর্মরত এক এএসআই।

জানা যায়, মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের দুই বছর পূর্ণ নিয়ে ২৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত হওয়া সমাবেশ করতে কারা মদদ দিয়েছে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। সমাবেশের পর থেকে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন মদদদাতাদের চিহ্নিত করতে মাঠে নামে। কারণ প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া রোহিঙ্গাদের একাধিক সংগঠন কক্সবাজারের কুতুপালং ক্যাম্পের এক্সটেন্সন ব্লকে বিশাল এ সমাবেশের আয়োজন করে।

সূত্রমতে, অন্যদিকে প্রত্যাবাসনে কৌশলী আগ্রহ অন্যদিকে আশ্রিত জীবনে লাখো রোহিঙ্গার সমাবেশ সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। এতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে স্থানীয়রা। বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে সরকার। এ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের সমাবেশ নিয়ে তদন্তে নামে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের নিয়ে গঠিত সংগঠন ছাড়াও যেসব এনজিও সংস্থা এবং সমাবেশে মদদদাতা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে কাজ করে জেলা প্রশাসন। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ের নামে গঠিত বেশ কয়েকটি সংগঠন এবং কয়েকটি এনজিও এবং ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের মাঝে উত্তেজনা সৃষ্টিকারী এসব সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসন থেকে এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর কাছে লিখিত অনুরোধ জানানো হয়েছে।

গত ১ সেপ্টেম্বর উখিয়া উপজেলা প্রশাসন থেকে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের সমাবেশের পূর্বে ‘এডিআরএ’ নামক একটি এনজিও সংস্থা গত ১৯ ও ২১ আগস্ট কক্সবাজার কলাতলিস্থ শালিক রেস্তোরায় বৈঠক করে। বৈঠকে আলোচিত রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহকে আড়াই লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়। এছাড়া ‘আল মারকাজুল ইসলামী সংস্থা’ সমাবেশে রোহিঙ্গাদের জন্য টি-শার্ট তৈরিতে সহযোগিতা করে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২৫ আগস্ট বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা দুই বছর পূর্তি উপলক্ষে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে ক্যাম্পে র‌্যালি ও সমাবেশের আয়োজন করে। ক্যাম্প-৪ এর ‘ই’ ব্লক এলাকায় সবচেয়ে বড় সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হয়। তাছাড়া রেজিস্টার্ড ক্যাম্পে ফুটবল খেলার মাঠ ডি-৫ ব্লক মাঠে ভিন্ন ভিন্ন সংগঠনের পক্ষে সমাবেশ ও র‌্যালি করা হয়। সমাবেশ সফল করতে ডি-৫ ব্লক ‘রোহিঙ্গা রিফিউজি কমিটি’ (আরআরসি) সংগঠনের চেয়ারম্যান সিরাজুল মোস্তাফার নেতৃত্বে ২৫ হাজার করে চাঁদা সরবরাহ করা হয়।

সংগঠনের সেক্রেটারি সাইফুল হকের নিকটাত্মীয় স্বজন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করায় তাদের কাছ থেকেও চাঁদা সংগ্রহ করা হয়। বিশেষ করে লন্ডনের নুরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি তাদের প্রায় ৫-৬ মাস আগে সংগঠনের অফিস নির্মাণের জন্য দুই লাখ টাকা অনুদান দেন। এই সংগঠনের মূল কমিটি ২৫ জনের। সমাবেশের টি-শার্ট তৈরি করতে ক্যাম্পে কর্মরত এক এএসআই’র মোটরসাইকেল ব্যবহার করা হয় বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

রোহিঙ্গাদের অধিকার আদায়ে গঠিত ‘ভয়েস অব রোহিঙ্গা’ এবং রোহিঙ্গা রিফিউজি কমিটির (আরআরসি) পক্ষ থেকে এ সমাবেশের আয়োজন করা হয়। ভয়েস অব রোহিঙ্গা ৭০০ সাদা হাফ টি-শার্ট ও ২৮টি ব্যানার উখিয়া উপজেলার মসজিদ মার্কেটের নিশাত পিন্টার্স ও মিডিয়া প্রিন্টার্স থেকে ছাপানো হয়। রোহিঙ্গা রিফিউজি কমিউনিটির (আআরসি) ১০০ হাফ টি-শার্ট ছাপানো হয় কক্সবাজার বাজারঘাটা শাহ মজিদিয়া প্রিন্টার্স থেকে। তবে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বেশকিছু সংগঠন কাজ করলেও মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বে পরিচালিত ‘আরকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউমিনিটি রাইটস’ (এআরএসপিএইচ) সংগঠনটি বেশ শক্তিশালী বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

প্রতিবেদন সূত্রমতে, মুহিবুল্লাহর সংগঠনের ৩০০ জন সক্রিয় সদস্য রয়েছে। এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রয়েছেন উখিয়া সিকদার পাড়া এলাকার আব্দুল করিম ভূঁইয়ার ছেলে উখিয়া কলেজের প্রভাষক নুরুল মাসুদ ভূঁইয়া। ২৫ আগস্ট তিনি উপজেলার মানবাধিকার সংগঠন ‘পিসওয়ে হিউম্যান রাইটস সোসাইটি’র সাধারণ সম্পাদক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এবং সমাবেশে অংশগ্রহণ করেন। মাসুদের পূর্ব পুরুষ মিয়ানমারের নাগরিক বলেও উল্লেখ করা হয়।

এদিকে প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, সংগঠনটির ৭ সদস্যের একটি উপদেষ্টা কমিটি রয়েছে। যারা কক্সবাজারের স্থায়ী বাসিন্দা। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মুহিবুল্লাহর সাথে মার্কিন রাষ্ট্রদূত রবার্ট মিলারের একটি মিটিং হয়। এরপর তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পান। গত ২৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত সমাবেশে যেসব ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গা সংগঠনগুলো সহযোগিতা পায়নি, সেসব ক্যাম্পের মাঝিদের ওপর হামলা চালানো হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এতে বলা হয়, গত ৩১ আগস্ট রাতে পালংখালী ইউনিয়নের জামতলি ১৫ নং ক্যাম্পের হেডমাঝি ফারুক ও সহকারি মাঝি রহিমের ওপর হামলা চালিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করে আর্মি চেকপোস্টের সামনে ফেলে রেখে চলে যায়। হেডমাঝি ফারুক মুহিবুল্লাহবিরোধী বলে তাদের ওপর এ হামলা চালানো হয়েছে।

একইসঙ্গে অন্যান্য ক্যাম্পের মাঝিদের মাঝে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করতে হামলার পরিকল্পনা বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

এদিকে, উপজেলা প্রশাসনের পাঠানো প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে জেলা প্রশাসন গত ৩ সেপ্টেম্বর এনজিও ব্যুরোতে একটি প্রতিবেদন পাঠান। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ডি-৫ ব্লকের রোহিঙ্গা রিফিউজি কমিটির (আরআরসি) চেয়ারম্যান সিরাজুল মোস্তফা এবং সেক্রেটারি সাইফুল হকের নেতৃত্বে সামবেশটি পরিচালিত হলেও ‘ভয়েস অব রোহিঙ্গা’ এবং ‘রোহিঙ্গা রিফিউজি কমিটি’ও সামাবেশে অংশগ্রহণ করে। তবে ক্যাম্প-৪ এ সবচেয়ে বড় সমাবেশ করতে সক্ষম হয় ‘আরকাইন রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউমিনিটি রাইটস’ (এআরএসপিএইচ) নামে সংগঠনটি। এ সংগঠনের সভাপতি মুহিবুল্লাহ এবং সাধারণ সম্পাদক উখিয়ার সিকদার বিল এলাকার বাসিন্দা ও উখিয়া কলেজের প্রভাষক নুরুল মাসুদ ভূঁইয়া সমাবেশের নেতৃত্ব দেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, নুরুল মাসুদ ভূঁইয়ার পূর্ব পুরুষ মিয়ানমারের বাসিন্দা ছিলেন। এছাড়া ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে রয়েছেন মাস্টার আব্দুর রহিম। রয়েছে সংগঠনের ৭ সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টা। এদের মাঝে সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবীসহ রয়েছেন কক্সবাজার দায়রা জজ আদালতের দু’আইনজীবী এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. ফরিদুল আলম ও মৌলনা ইউসুফ।

ক্যাম্পে কর্মরত এক এএসআই’র মোটরসাইকেল ব্যবহার করে কমিটির কর্মকর্তারা ইনানী পর্যন্ত যান। সেখান হতে কক্সবাজার গিয়ে সমাবেশে ব্যবহৃত টি-শার্ট তৈরি করা হয়। উখিয়া উপজেলার মসজিদ মার্কেটের নিশাত প্রিন্টার্স এবং কক্সবাজার পৌরসভার বাজারঘাটাস্থ শাহ মজিদিয়া প্রিন্টার্স হতে টি-শার্ট ও ব্যানার ছাপানো হয় বলে উল্লেখ করা হয়।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, সমাবেশের আগে ‘এডিআরএ’ নামের সংস্থার সঙ্গে গত ১৯ আগস্ট এবং ২১ আগস্ট মুহিবুল্লাহর অনুষ্ঠিত বৈঠকে আড়াই লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয় এবং ‘আল মারকাজুল ইসলামী সংস্থা’ সমাবেশে টি-শার্ট তৈরিতে সহযোগিতা করে। সংস্থাদ্বয় জেলা এবং উপজেলা এনজিওবিষয়ক সমন্বয় সভায় নিয়মিত উপস্থিত থাকে না এবং তাদের কাজের নিয়মিত প্রতিবেদনও জমা দেয় না। এ অবস্থায় এডিআরএ এবং আল মারকাজুল ইসলাম নামের সংস্থার বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানানো হয়।

এএইচ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!