রোজগার বন্ধ, দাদন ব্যবসায়ীদের খপ্পরে চট্টগ্রামের নিম্ন আয়ের মানুষ

৫০ বছর বয়সী খলিল। পেশায় সিএনজিচালক। থাকেন আমবাগান বাস্তহারা কলোনিতে। ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েনছে সপ্তাহে ১৭৫০ টাকা করে ৪ সপ্তাহে পরিশোধের শর্তে। সাক্ষী প্রতিবেশী ২ জন। দ্বিতীয় সপ্তাহে কিস্তি দিতে পারেননি খলিল। এই টাকার জন্য দাদন ব্যবসায়ী হানিফ এসে শুরু করে কলার ধরে টানাটানি। শেষে আরও ৫০০ টাকা বেশি দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে সাময়িক রক্ষা পান খলিল।

শুধু খলিল নয়, করোনার এই দুর্যোগের সময়েও চট্টগ্রামজুড়ে দাদন ব্যবসায়ীদের খপ্পরে আটকা পড়েছে হাজারও নিম্ন আয়ের এমন মানুষ।

করোনার প্রকোপ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেছে কারখানা। ঘুরছে না যানবাহনের চাকা। বন্ধ গার্মেন্টসও। খেটে-খাওয়া মানুষের আয়-রোজগারের সব পথে বসেছে লকডাউনের খড়গে। এতে নিম্ন আয়ের মানুষের আর্থিক সংকট বেড়ে যাওয়ার সুযোগে চড়া সুদে ঋণ দিয়ে লাল হচ্ছে একশ্রেণীর দাদন ব্যবসায়ী। তাদের খপ্পরে পড়ে ফেঁসে যাচ্ছে রিক্সাচালক, সিএনজি অটোরিকশা চালক, ফুটপাতের চায়ের দোকানদার, গার্মেন্টস শ্রমিক— এমনকি মধ্যবিত্তরাও।

চট্টগ্রাম নগরীর আকবরশাহ, লালখান বাজার, বায়জীদ, সাগরিকা, আমবাগান বাস্তহারা কলোনীর বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, খুলশী থানার মাস্টার লেইন এলাকার রোজী, আকবরশাহ থানা এলাকার ফাতেমা, আনজু, জয়নবী ও নুর হোসেন এবং লালখান বাজার এলাকায় নাসরিন এই দাদন ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তবে তাদের কেউই এ ব্যবসাকে ‘অবৈধ’ বলতে নারাজ।

দাদন ব্যবসায়ীদের দাবি, কেউ তাদের কাছ থেকে টাকা চাইলে তারা দিচ্ছেন। জোর করে কাউকে তারা টাকা দিচ্ছেন না। আবার জোর করে আদায়ও করছেন না। সম্পর্ক থাকায় লোকজনকে বন্ধক ছাড়াই ধার দিচ্ছেন। যারা ধার নিচ্ছেন তারা সুবিধাজনক সময়ে শর্ত অনুযায়ী ফেরত দিচ্ছেন।

দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা ধার নেওয়া কয়েকজন খেটে-খাওয়া মানুষ জানান, ১ হাজার টাকায় এক মাসে সুদ দিতে হচ্ছে ৪০০ টাকা। যদি এক সপ্তাহ কিস্তির টাকা দিতে না পারে অতিরিক্ত ২০০ টাকা প্রতি সপ্তাহের জন্য দিতে হবে তাকে। কাজকর্ম না থাকায় পেটের দায়ে বাধ্য হয়েই কেউ ৫ হাজার, কেউ আরও বেশি সুদে টাকা নিচ্ছেন দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। টাকা আদায়ে সমস্যা হলে বিষয়টির মধ্যস্থতা করে দিচ্ছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও।

বিষয়টি স্বীকার করে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মহিলা কাউন্সিলর বলেন, ‘বিষয়টি আমি শুনেছি। সপ্তাহের কিস্তি পরিশোধ করতে না পারায় অনেক দাদন ব্যবসায়ী মারধরও করছে নিম্ন আয়ের মানুষকে। এ নিয়ে বিচারও আসছে প্রতিদিন। এখন চুপ করে আছি। ঋণ নিয়ে আপাতত জীবনটা বাঁচাক নিম্ন আয়ের মানুষ।’

বাস্তুহারা কলোনীর বাসিন্দা সিএনজি অটোরিকশা চালক খলিল জানান, স্ত্রীসহ ৫ জনের সংসার তার। ছেলে কলেজে যায়। মেয়েও মেট্রিক পাশ করলো। আজ ১৫ দিন তার গাড়ি চলে না। বাড়ি ভাড়া দিতে হয়েছে। ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খরচ, নিজের ও স্ত্রীর চিকিৎসা খরচ, বিদ্যুৎ ও গ্যাস বিল, মাসিক বাজার খরচ সব চালাতে হচ্ছে। তাই বাধ্য হয়েই তাকে দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে উচ্চ সুদে ৫ হাজার টাকা ঋণ নিতে হল। প্রথম সপ্তাহের কিস্তি দেওয়ার পর রোজগার না থাকায় দ্বিতীয় সপ্তাহে কিস্তি পরিশোধ করার সুযোগ হয়নি তার। তাই দাদন ব্যবসায়ী এসে তাকে মারধর করেছে। পরের সপ্তাহে কিস্তির সঙ্গে তাকে ৫০০ টাকা অতিরিক্ত সুদ দিতে হবে।

সাগরিকা এলাকার নিম্ন মধ্যবিত্ত নারী বকুল (৩০) জানান, তার স্বামী ক্রোকারিজ ও কাপড় ব্যবসায়ী। রিয়াজ উদ্দিন বাজারে দোকান আছে তাদের। ঈদের বাজারে বেচা-কেনার আশায় ব্যাংক থেকে লোন নিয়েই দোকানের মাল তুলেছিল তার স্বামী। এখন ব্যবসা বন্ধ হওয়ায় একদিকে লোনের কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে। অন্যদিকে দুই সন্তানের পড়াশোনা, ঘরের যাবতীয় খরচ নিয়ে বিপাকে তারা। বাধ্য হয়েই দাদন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়েছেন এক মাসের জন্য। চার কিস্তিতে তাকে দিতে হবে ১৪ হাজার টাকা।

তিনি বলেন, ‘বোঝাতে পারছি না কষ্টের কথা। এখন সুদমুক্ত ঋণ দিয়ে সরকার চাইলে পারে মধ্যবিত্তদের বাঁচিয়ে রাখতে।’

এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে এ বিষয়ে কোন অভিযোগ না যাওয়ায় তারাও রয়েছে অন্ধকারে। খুলশী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কবির আহমেদ এ বিষয়ে বলেন, ‘দাদন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কেউ এখনও অভিযোগ দেয়নি। কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ নিয়ে এলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।’

১০ নম্বর ওয়ার্ড মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নারগিস আক্তার নীরা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘আসলে নিম্ন আয়ের মানুষগুলো অনেক কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। সাহায্য প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল হওয়ায় তারা দাদন ব্যবসায়ীর কাছে গিয়ে চড়া সুদে টাকা নিচ্ছে। অল্প টাকাগুলো তাদের কাছে বিষফোঁড়া হয়ে দাড়াবে হয়তো।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘দাদন ব্যবসা শুরু থেকেই গরিবদের শোষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে খেটে-খাওয়া দিনমজুরদের বেশির ভাগই দাদন ব্যবসায়ীদের যাঁতায় পিষ্ট হচ্ছে এখনো। এর প্রধান কারণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো খেটে-খাওয়া সাধারণ মানুষের দুঃখের সারথী হতে পারেনি। অভাবগ্রস্থ মানুষ শুধু এটুকু জানে তার জন্য কেউ নেই। তাই সে বাধ্য হয়ে যায় দাদন ব্যবসায়ীর কাছে। ৫ হাজার টাকা নিয়ে ২০ হাজার টাকা পরিশোধ করেও সে পার পায় না।’

তিনি আরও বলেন, ‘করোনাভাইরাস মহামারী আকার ধারণ করার আগেই সরকারের নিম্ন আয়ের মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে যতগুলো পদক্ষেপ নেওয়া উচিত তার মধ্যে অন্যতম দাদন ব্যবসা নিষিদ্ধ করে সুস্পষ্ট প্রজ্ঞাপন জারি করা। কারণ যখনই কোনো ক্রাইসিস হয় রাষ্ট্রীয়ভাবে তখনই নিম্ন আয়ের মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নেয় এমন কিছু মানুষ। এছাড়া দাদন ব্যবসায়ীদের ফাঁদে পা না দিতে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি সরকারের উচিত নিম্ন আয়ের মানুষকে বিনা সুদে লোন দিতে সরকারি ও বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দেওয়া।’

এমএফও

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!