রেলে টেন্ডার জালিয়াতির পর এবার অভিনব ‘বিজ্ঞাপন’ জোচ্চুরি

আরেফিন সিন্ডিকেট আবার সক্রিয়

রেলে টেন্ডারসহ নানা কিছু নিয়ে জালিয়াতি নিত্যদিনের ঘটনা হলেও এবার হয়েছে অভিনব জালিয়াতি। চট্টগ্রামের একটি আঞ্চলিক দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় চট্টগ্রাম প্রতিদিনে প্রকাশিত একটি সংবাদের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে দেওয়া বিজ্ঞাপন নিয়েও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ডিজেলশপের একটি চক্র।

জানা গেছে, রেলওয়ের নিয়মিত সরকারি বিজ্ঞাপনের কথা বলে প্রায় লক্ষাধিক টাকা মূল্যের ওই ‘প্রতিবাদলিপি’ বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশের জন্য দেওয়া হয় চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী পত্রিকায়।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে জানা গেছে, রেলওয়ের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো বিজ্ঞাপনই দেওয়া হয়নি। অথচ প্রকাশিত বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয়েছে রেলওয়ের লোগো ও রেলের পাহাড়তলী ডিজেলশপের নাম। বাংলাদেশ রেলওয়ে (পূর্বাঞ্চল) কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানিয়েছে, এ ধরনের কোনো বিজ্ঞাপন পত্রিকায় প্রকাশের জন্য তারা দেয়নি। এ বাবদ কোনো বিল পরিশোধেরও প্রশ্নই আসে না। বিজ্ঞাপনটি প্রকাশের দায়দায়িত্ব রেলওয়ে নেবে না। এটি চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ডিজেলশপের তত্ত্বাবধায়ক রাজীব কুমার দেবনাথের ব্যক্তিগত হতে পারে বলে তারা জানিয়েছে।

কিন্তু ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনে রেলের লোগো ব্যবহার করা যায় কিনা— এমন প্রশ্নে কর্তৃপক্ষ পুরো বিষয়টি বেআইনি বলে মন্তব্য করেছে। দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনে ৪ অক্টোবর ‘অনিয়মের কারখানা রেলওয়ে ডিজেল শপ চলে এক ঠিকাদারের ইশারায়, একবার জিনিস কিনে বিল তোলা হয় পাঁচবার’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। এর প্রতিবাদে ওই বিজ্ঞাপনটি প্রকাশিত হয়। সেখানে ‘ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ মেরামত কারখানা, পাহাড়তলী কর্তৃপক্ষের’ নাম উল্লেখ করা হলেও কোনো ব্যক্তির নাম ওই বিজ্ঞাপনে ছিল না। রেলের মতো সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বশীল কর্তাদের এড়িয়ে এমন বিজ্ঞাপন জালিয়াতি কর্মকর্তাদের মধ্যেও কৌতূহল তৈরি করেছে।

রেলের লোগো ব্যবহার করা হলেও সরকারি বিজ্ঞাপনের প্রকাশনা নিয়ম অনুসারে ওই বিজ্ঞাপনে কোনো স্মারক নম্বর ছিল না। এছাড়া দৈনিক আজাদীর বিজ্ঞাপন বিভাগে ওই প্রতিবাদলিপিকে ‘সরকারি বিজ্ঞাপন’ হিসেবে প্রকাশের অনুরোধ জানানো হলেও তাদের কাছে সরকারি বিজ্ঞাপনের কোনো অনুমতিপত্র কিংবা কার্যাদেশও দেয়নি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ।

চট্টগ্রাম প্রতিদিনের অনুসন্ধানে রেলওয়ের নামে বিজ্ঞাপন নিয়ে এমন অভিনব জালিয়াতিতে পাহাড়তলী ডিজেলশপের তত্ত্বাবধায়কের রাজীব কুমার দেবনাথ ও জনসংযোগ অফিসের পিয়ন শামসুল আরেফীন জড়িত বলে জানা গেছে। তবে এই বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য রাজীব কুমার দেবনাথকে বেশ কয়েকবার ফোন করেও তার কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রায় দেড় বছর ধরে ডিজেলশপের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে রয়েছেন রাজীব কুমার দেবনাথ। অভিযোগ রয়েছে, রাজীব কুমার দেবনাথ ও ঠিকাদার নুরে আজম বাচ্চু মিলে এই রেলওয়ের কারখানার যাবতীয় টেন্ডার কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছেন।

জানা গেছে, প্রায় লক্ষাধিক টাকা মূল্যের বিজ্ঞাপনটি প্রকাশ করলেও দৈনিক আজাদী এ বাবদ কোনো টাকাও পায়নি। এ বিষয়ে দৈনিক আজাদীর বিজ্ঞাপন কর্মকর্তা নুরুল হুদা চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, ‘রেলের জনসংযোগ বিভাগের পিয়ন শামসুল আরেফীন ৫ অক্টোবর রাতে একটি প্রতিবাদ বিজ্ঞাপন নিয়ে আজাদী অফিসে আসে। আরেফীন এটিকে সরকারি বিজ্ঞাপন বলে জানায়। তবে এর অনুমতিপত্র কিংবা কার্যাদেশ আজ (বুধবার) অফিসে পাঠানোর কথা থাকলেও তা পাঠায়নি।’

তিনি বলেন, সরকারি কার্যাদেশ ছাড়া কোনো সরকারি বিজ্ঞাপন প্রকাশ হওয়ার নিয়ম না থাকলেও রেলের পিয়ন শামসুল আরেফীনের সঙ্গে পূর্ব পরিচয়ের কারণে এটি ছাপা হয়েছে। তবে ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনে সরকারি প্রতিষ্ঠানের লোগো ব্যবহার হয় না।’

এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে চট্টগ্রামের উপ পরিচালক/জনসংযোগ (পূর্ব) তৌষিয়া আহমেদ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘এই বিজ্ঞাপনের কোন টাকা রেল কর্তৃপক্ষ দেবে না। এটি ডিজেলশপের তত্ত্বাবধায়ক রাজীব কুমার দেবনাথ পরিশোধের কথা। এটি কোনো সরকারি বিজ্ঞাপন না। সরকারিভাবে এ বিজ্ঞাপন প্রকাশের কোন অনুমতি নেই।’

রাজীব কুমার দেবনাথের ব্যক্তিগত প্রতিবাদ বিজ্ঞাপনে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের লোগো ব্যবহার কেন— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এমন তো হওয়ার কথা না।’ এই কর্মকর্তা প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের মূল্য শুনেও বিস্ময় প্রকাশ করেন।

জনসংযোগ অফিসের উর্ধতন কর্মকর্তা এমন কথা বললেও ওই অফিসের পিয়ন শামসুল আরেফীন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রকাশিত প্রতিবাদ বিজ্ঞাপনটি সরকারিভাবেই প্রকাশ হয়েছে। এটির টাকা সরকারি বিজ্ঞাপন হারে পরিশোধ হবে।’

পরে আবার ওই পিয়ন জানান, ‘বিজ্ঞাপনের টাকা আসলে পরিশোধ করার কথা ডিজেলশপের তত্ত্বাবধায়ক রাজীব কুমার দেবনাথ স্যারের। সন্ধ্যায় স্যার টাকা দিলে বিল পরিশোধ করবো।’

ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনে এতো টাকার উৎস কী এবং রেলের লোগো ব্যবহার করা হল কিভাবে— এ প্রসঙ্গে পিয়ন শামসুল আরেফীন বলেন, ‘এসব স্যারে (রাজীব কুমার দেবনাথ) জানেন।’

এর আগে রেলওয়ে চট্টগ্রাম পূর্বাঞ্চলের ৬৩৯টি প্লট বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বরাদ্দের দরপত্রে অভিনব কৌশলে জালিয়াতির ঘটনা নিয়ে আলোড়ন তৈরি হয়েছিল। নিজের পছন্দের লোককে প্লট পাইয়ে দিতে অভিনব পদ্ধতিতে জালিয়াতির আশ্রয় নেয় রেলওয়েকেন্দ্রিক একটি চক্র। দরপত্র বিজ্ঞপ্তি না দিয়ে পত্রিকার ভুয়া কাটিং জমা দিয়েই নিজের পছন্দের লোককে কাজও পাইয়ে দিয়েছে এই চক্রটি।

দরপত্র নিয়ে জালিয়াতির এই ঘটনায় লেনদেন হয়েছিল বিশাল অঙ্কের অর্থ। যা ভাগাভাগি হয়েছে রেলওয়ে অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও। অভিনব এই জালিয়াতির মূল হোতা ছিলেন রেলওয়ে চট্টগ্রামের উপ-পরিচালকের (জনসংযোগ) কার্যালয়ের অফিস সহকারী শামসুল আরেফীন। তার সঙ্গে জড়িত ছিলেন রেলওয়ের কয়েকজন উর্ধতন কর্মকর্তাও। তবে এই ঘটনায় দায় সারতে কেবল অফিস সহকারী শামসুল আরেফীনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। কিন্তু পরে তদবির ও টাকা ঢেলে অভিযুক্ত শামসুল আরেফীন আবার রেলে ফিরে আসেন।

জানা গেছে, আরেফীনের ফিরে আসার পর থেকে টেন্ডার জালিয়াতির সেই চক্রটি আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সরকারি নিয়ম অনুসারে প্রতিষ্ঠিত পত্রিকায় টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ না করে তারা নিজেরই রাতারাতি হুবহু দৈনিক পত্রিকার আদলে বিজ্ঞাপনটি ছেপে প্রতারণা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।। এ নিয়ে গত বছরের ৩ জুলাই চট্টগ্রাম প্রতিদিনে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!