রুগ্ন জেনারেল হাসপাতাল ভুগছে ‘নেই’ রোগে

দক্ষিণ চট্টগ্রামের পটিয়া থেকে সাত মাস বয়সী শিশু হুমায়রাকে নিয়ে শহরে ছুটে এসেছিলেন রিকশাচালক বাবা সাইফুল। টানা ৬ দিনের জ্বরে নাজেহাল মেয়েটির মুখের দিকে তাকাতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন মা হোসনে আরা বেগম। দারিদ্র্যের কারণে চেম্বারে গিয়ে ডাক্তার দেখাতে না পেরে প্রতিবেশীদের পরামর্শে নিয়ে আসেন চট্টগ্রাম নগরের জেনারেল হাসপাতালে। পাঁচ টাকায় টিকেট কিনে ডাক্তার দেখিয়েও স্বস্তি পাননি তিনি। হাসপাতালে আইসিইউ ও সিসিইউ সেবা না থাকায় শিশু হুমায়রাকে দ্রুত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) পাঠানোর পরামর্শ দেন ডাক্তার।

চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লায় জেনারেল হাসপাতালে ৫ টাকার টিকেটে আউটডোর চিকিৎসাসেবা এবং বিনামূল্যে ওষুধ পেতে বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ ছুটে আসে প্রতিদিন। সরকারি এই হাসপাতালটি চট্টগ্রামের অধিকাংশ নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবার নির্ভরশীলতার স্থান হলেও অপর্যাপ্ত জনবল ও সরঞ্জাম সংকটে পড়ে হাসপাতালটি নিজেই জীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে।

চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লার ২৫০ শয্যার প্রাচীন এই হাসপাতালটি বর্তমানে জরাজীর্ণপ্রায়। এ অবস্থায় চিকিৎসাসেবা দেওয়াও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। জনবল সংকটের মধ্যেও প্রতিদিন বহির্বিভাগে নতুন ১০০০ থেকে ১২০০ এবং পুরনো ৩০০-৪০০ রোগীকে চিকিৎসাসেবা দিতে হয়।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালে আইসিইউ ও সিসিইউতে সেবা না থাকায় জটিল রোগের চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। দেখা যায়, একজন ডাক্তারকে পাঁচ ওয়ার্ডে চিকিৎসাসেবা দিতে হয়। হাসপাতালের নানা সমস্যার বিষয়ে একাধিকবার মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠালেও কোন সাড়া পায় না হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ—সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো একথা জানিয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ২৫০ শয্যার এই জেনারেল হাসপাতালে প্রয়োজনের তুলনায় ডাক্তার কম থাকায় চিকিৎসা প্রদানে ব্যাঘাত ঘটছে। প্রয়োজনের তুলনায় পরিছন্নতা কর্মীও অনেক কম। নেই কোন নিরাপত্তাকর্মী। অ্যাম্বুলেন্সেও রয়েছে যান্ত্রিক ক্রটি। পুরোনো বিল্ডিং এবং লিফটের সংস্কার জরুরি হয়ে পড়েছে।

জানা যায়, অতীতে চিকিৎসক ও জনবল না বাড়িয়ে জেনারেল হাসপাতালকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। ১৫০ শয্যার অবকাঠামো দিয়ে চলছে ২৫০ শয্যার এই হাসপাতালের কার্যক্রম। সেই ২০১১ সালে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করা হলেও জনবল এখনও মঞ্জুরি হয়নি। ফলে তিন মাস পর পর চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু তার জবাব আসে না।

বর্তমানে হাসপাতালে মঞ্জুরিকৃত পদ রয়েছে ১৭৮। এর মধ্যে রয়েছেন ১৫৮ জন। শূন্য রয়েছে ২০টি পদ। এছাড়া আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে আরো ৩৬ জনকে নিয়োজিত করা হয়েছে। তবে ২৫০ শয্যার হাসপাতালের জন্য জনবল দরকার আরো বেশি। চিকিৎসক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ ২৬২ জনের একটি অর্গানোগ্রাম তৈরি করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সরকারের কাছে চাহিদাপত্রও পাঠিয়েছিল। তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি।

হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ আটটি ওয়ার্ডে ১০টি বিভাগ রয়েছে। নতুন করে ১২ তলা ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোন সাড়া পাওয়া যায়নি বলে জানা যায়। রোগ নিরূপণ করার গুরুত্বপূর্ণ এক্সরে, আলট্রাসনোগ্রাফি ও এমআরআই মেশিন থাকলেও টেকনোলজিস্ট নেই হাসপাতালে। এই তিনটি মেশিন চালানোর ৬ জন টেকনোলজিস্ট থাকার কথা থাকলেও বিপরীতে রয়েছে মাত্র একজন। আলট্রাসনোগ্রাফিতে দিনে ৪০-৫০ জন রোগী আসে।

তবে হাসপাতালটির দক্ষ ইএনটি (নাক, কান ও গলা) সার্জন আছে। এ কারণে বাইরের হাসপাতাল থেকে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের ইএনটিতে অপারেশনের জন্য রোগীকে রেফার করা হয় বলে জানান হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. অসীম কুমার নাথ।

জানা যায়, টেকনোলজিস্টের পাশাপাশি রেডিওলজি এন্ড ইমেজিং বিভাগের এই তিনটি মেশিনের জন্য কনসালটেন্টেরও সংকট রয়েছে হাসপাতালে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ৩টি মেশিনের ৯ জন কনসালটেন্ট প্রয়োজন, অথচ সেখানে রয়েছে একজন। পর্যাপ্ত কনসালটেন্ট ও টেকনোলজিস্ট থাকলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হতো বলে মনে করেন হাসপাতালের এই তত্ত্বাবধায়ক।

হাসপাতালের গাইনি বিভাগে প্রতিদিন ৪-৫টি, ইএনটিতে ৩টি এবং অর্থোপেডিকে ৩টি অপারেশন হয়। চাহিদা অনুযায়ী ভবন না থাকায় ঠাসাঠাসি করে রোগীর শয্যা বসানো হয়েছে। হাসপাতালটিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সেবা রয়েছে—কুকুরের কামড়ের চিকিৎসা।

আবাসিক মেডিকেল অফিসার দীনেশ চন্দ্র শীল চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, বর্তমানে নগরে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ডেঙ্গু মোকাবেলায় আমরা কাজ করে যাচ্ছি। এ পর্যন্ত ১৫০ জন রোগীকে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো হয়েছে। রোগীদের সেবায় আমরা আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চটুকু দিয়ে থাকি। প্রতি সপ্তাহে একদিন চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিতকরণে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। অসহায় দরিদ্র রোগীদের জন্য রোগী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হয়। চিকিৎসা সেবা প্রদানে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ খুবই আন্তরিক বলে তিনি দাবি করেন।

সীমিত জনবল নিয়ে উন্নত চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. অসীম কুমার নাথ চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘জনবল সংকট আর অপ্রতুল সরঞ্জামাদির মাঝে রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছি আমরা।’

জনবল নিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত ছাড়া এ জনবল নিয়োগ সম্ভব নয়। নিয়োগের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে একাধিকবার জানানো হয়েছে। হাসপাতালের জন্মলগ্ন থেকে একই মেশিন দিয়ে আমরা চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যাচ্ছি। ওটি ও ল্যাবরেটরিকে আধুনিকায়ন করা, জনবল নিয়োগ, সর্বাধুনিক বিল্ডিং, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি পেলেই এ হাসপাতালের চিকিৎসা সেবা আরও উন্নত করা সম্ভব হবে।’

হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা মো. আবু তাহের বলেন, ‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট আন্তরিক। তবে জনবলের অভাবে অনেক সময় সেবা পাওয়া যায় না। এছাড়া বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির এমআরদের তৎপরতা খুব বিরক্তিকর।’

এসএস/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!