রাশিয়াই জানালো গম চুরি হচ্ছে চট্টগ্রামের সাইলোতে, বেল্টে চলে গোপন কারসাজি

চুরি হচ্ছিল কয়েক বছর ধরে, কর্তৃপক্ষ বরাবরই নিশ্চুপ

চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গায় সাইলো জেটিতেই খালাস হয় গম। দীর্ঘদিন ধরে এই সাইলোতে গম চুরির ঘটনা ঘটলেও কর্তৃপক্ষের সেটা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। এবার রীতিমতো উষ্মা প্রকাশ করে রাশিয়া থেকেই জানানো হলো চট্টগ্রামের সাইলোতেই ঘটছে গম চুরির ঘটনা। বিদেশি একটি সরকারের কাছ থেকে এমন অপমানজনক তথ্য জানানোর পর টনক নড়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের। ইতিমধ্যে গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটিও। এর মধ্যে শাস্তিমূলক বদলিও করা হয়েছে সাইলো স্কেল অপারেটরকে।

জানা গেছে, দেশে খাদ্য ঘাটতি পূরণ করতে রাশিয়ান ফেডারেশন থেকে জি-টু-জি (সরকার থেকে সরকার) পদ্ধতিতে গম আমদানি করছে বাংলাদেশ। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে জিটুজি প্যাকেজ-৪ এবং প্যাকেজ-৫ এ আসা ১ লাখ মেট্রিকটন গম খালাসের সময় বড় আকারের গম চুরির ঘটনা ঘটে। শুরুতে রাশিয়া থেকেই গম পরিমাণে কম দেওয়া হয়েছে— এমন খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে নিশ্চুপ থাকে কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বাংলাদেশেই এই গম চুরি হয়েছে— রাশিয়ান সরকার এই তথ্য নিশ্চিত করে চিঠি দেয় বাংলাদেশ সরকারকে। এরপরই খাদ্য মন্ত্রণালয় বিষয়টি তদন্তের উদ্যোগ নিল।

তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে খাদ্য অধিদপ্তরের ডিরেক্টর জেনারেল (ডিজি) আবদুল আজিজ মোল্লাকে। সদস্য করা হয় এডিশনাল ডিরেক্টর প্রকিউরম্যান মো. মনিরুজ্জামান, চট্টগ্রামের সাইলো সুপার ও মোংলা বন্দরের সাইলো সুপার, সাইলো ম্যানেজমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার ও সাপ্লাইয়ার প্রতিনিধিকে। এই তদন্ত কমিটি জানুয়ারির শেষ দিকে চট্টগ্রাম বন্দরের সাইলো জেটি পরিদর্শন করে গেলেও এখনও রিপোর্ট দিতে পারেনি।

জানা গেছে, রাশিয়া থেকে পাঠানো গমের মোট দুটি প্যাকেজের এক চালানে ৫০০ টন এবং অপর চালানে প্রায় ৭০০ টন গম চুরি হয়ে যায়।

গত ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে দৈনিক চট্টগ্রাম প্রতিদিনে এই গম চুরির ব্ষিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর চট্টগ্রামের সাইলোতে গম চুরির বিষয়টি প্রকাশ্যে এলেও বিষয়টি ধামাচাপা দিতেই ব্যস্ত ছিল কর্তৃপক্ষ। যার দিকে উঠেছে সন্দেহের তীর, সাইলোর সেই অধীক্ষক আসাদুজ্জামানও বহাল তবিয়তে রয়ে যান।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দরের সাইলো জেটিতে জাহাজ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে খালাস করা হয় গম। তিনটি নিউমেটিক আনলোডার দিয়ে জাহাজের হ্যাজ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গম খালাস করে প্রায় ৫০০ মিটার দীর্ঘ বেল্টের মাধ্যমে চলে যায় গুদামে। মূলত এই বেল্ট থেকেই বিশেষ কৌশলে চুরি করা হয় গম।

অভিযোগ রয়েছে, মাদার ভ্যাসেল থেকে নিউমেটিক আনলোডার দিয়ে জাহাজের হ্যাজ থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে গম খালাস করে গুদামজাত করার সময় সাইলো কর্মকর্তাদের যোগসাজশে লাইটার জাহাজে অতিরিক্ত বোঝাই করে চুরি করা হয় গম। যা নারায়ণগঞ্জ নেওয়ার পথে চাঁদপুরে বিক্রি করে দেওয়া হয়। আবার নারায়ণগঞ্জের সাইলোতে কম না পড়ে মতো ওজনে সমান রাখা হয়। পথে কৌশলে পাচার হয়ে যায়। এতে লাইটারে অতিরিক্ত বোঝাই করা গম মাদার ভ্যাসেলে আমদানি করা গমের ওজনে কম পড়ে।

ব্যবসায়ীরা জানান, বিদেশ থেকে আমদানি করা গম চট্টগ্রামের সাইলোতে এলেই ৫০০ থেকে ১ হাজার মেট্রিক টন কমে যায়। এই গম সাইলোতেই চুরি হয় এভাবে। এতে ব্যবসায়ীদের চরম ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সাইলোতে গম বোঝাই মাদার জাহাজ ভিড়লে সেটি থেকে অর্ধেক গম আনলোড করে দাঁড় করিয়ে রাখা হয় দিনের পর দিন। এতে বন্দরের চার্জ ও জাহাজের অতিরিক্ত ভাড়া গুণতে হয় ব্যবসায়ীদের। জাহাজের গম খালাসের জন্য শ্রমিক, বন্দরের স্টাফ, স্টিভিডোর ও সাইলো অপারেটদের ২৪ ঘন্টায় তিন শিফটে দৈনিক ১৫ হাজার টাকা দিতে হয়। অথচ তারা সরকারি বেতন-ভাতাও পাচ্ছেন। এসব নানা অনিয়মের কারণে এখন রাশিয়া থেকেই অভিযোগ এলো গম চুরির।

গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক ভার্চুয়াল সভায় দুই লাখ মেট্রিক টন গম রাশিয়া থেকে আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়। চুরির আপত্তি তুলে রাশিয়া ওই দুই লাখ মেট্রিক টন গম বাংলাদেশে আর পাঠায়নি। এর আগে অনুমোদন হওয়া একটি প্যাকেজের গম সর্বশেষ ২৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছিল। এর পর থেকে রাশিয়ার গম আর বাংলাদেশে আসেনি এ পর্যন্ত।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সাইলোর অধীক্ষক মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, ‘চুরির বিষয়টি আমার জানা নেই।’

স্কেল অপারেটরকে শাস্তিমূলক বদলির বিষয়টি নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘অপারেটর বদলির বিষয়টি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া।’

সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়া থেকে গম না আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি ‘অফিসে এসে কথা বলা’র অনুরোধ জানান।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!