রাতে নওফেলকে নিয়ে ৫ আওয়ামী লীগ নেতার হঠাৎ বৈঠক ফিরিঙ্গিবাজারের বাড়িতে (ভিডিও)

নাছির অনুসারীরা বলছেন, ষড়যন্ত্রের ছক কাটা হচ্ছে

হঠাৎ করেই মহিউদ্দিন চৌধুরী পুত্র মহিবুল হাসান নওফেলকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের পাঁচ নেতা অনেকটা গোপনে বৈঠকে বসলেন নগরীর এক বাসায়। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান ও নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি জহিরুল আলম দোভাষ ডলফিনের চট্টগ্রাম নগরীর ফিরিঙ্গিবাজারের বাসায় প্রায় দুই ঘন্টাব্যাপি এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় কঠোর গোপনীয়তার মধ্য দিয়ে।

এ সময় চট্টগ্রাম প্রতিদিনের আলোকচিত্রী ওই বাসার বাইরে থাকা গাড়ির ছবি তুলতে গেলেও পুলিশ তাতে বাধা দেয়। উপস্থিত অন্তত একজন নেতা বৈঠকের কথা জেনেছেন যাওয়ার সামান্য আগে।

মঙ্গলবার (২৮ ডিসেম্বর) রাত ৮টার দিকে বৈঠকটি যখন শুরু হয়, তখন সেখানে নওফেল ও ডলফিন দোভাষ ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি খোরশেদ আলম সুজন, কোষাধ্যক্ষ ও সিডিএর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম এবং বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক মশিউর রহমান চৌধুরী।

তবে ডলফিনের ফিরিঙ্গিবাজারের বাসায় পুলিশের পাহারায় শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেল ও সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর গাড়ি ঢুকতেই একান্ত বৈঠকের কথা আর গোপন থাকেনি। নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরের অনুসারীরা একে ‘ষড়যন্ত্রমূলক বৈঠক’ দাবি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব হয়ে ওঠেন। তাদের কেউ কেউ খোরশেদ আলম সুজনকে ‘রাজ্জাকি বাকশালী’ বলে অভিহিত করে আবদুচ ছালামকেও ‘সুবিধাবাদী’ বলে ক্ষোভ ঝাড়েন। তাদের কেউ কেউ মনে করছেন, মূলত আ জ ম নাছিরকে ঠেকানোর অংশ হিসেবেই তারা দফায় দফায় গোপন বৈঠকে বসছেন। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে গিয়ে মিথ্যা অভিযোগ তুলছেন।

আ জ ম নাছিরের অনুসারী ফিরিঙ্গিবাজারের বর্তমান কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব বৈঠককে ইঙ্গিত করে রাতেই ফেসবুকে লিখেন, ‘ষড়যন্ত্র করে লাভ নাই, আল্লাহ সহায়ক। সবর করো, ধৈর্য্য ধরো। প্রিয় নেতা একজন দানবীর, নামাজি, নফল রোজাধারী, মুমিন মুসলমান।’

বৈঠক শেষে রাত ১০টা ২০ মিনিটে প্রথমে ওই বাসা থেকে প্রথম বেরিয়ে আসেন মেয়র রেজাউল করিম। এরপর শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেল। কয়েক মিনিট পর বেরিয়ে আসেন সিডিএর সাবেক চেয়ারম্যান ও নগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ আবদুচ ছালাম।

পরে বৈঠকে উপস্থিত অন্তত তিনজন নেতাকে ফোন করা হলেও তারা সাড়া দেননি। একজনের মোবাইল ফোনই ছিল বন্ধ। তবে তাদের অনুসারীদের মতে, সামনে নগর আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড সম্মেলন এবং মার্চে সম্ভাব্য নগর কমিটি গঠনকে সামনে রেখে মূলত শিক্ষা উপমন্ত্রী নওফেলের উদ্যোগে কর্মকৌশল ঠিক করার অংশ হিসেবেই এই নেতারা একত্র হয়েছিলেন— যার মূলে রয়েছে ‘আ জ ম নাছির ঠেকাও।’

নানা সমীকরণের পর চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের পাঁচ বছর আগের মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি এখন আগামী মার্চকে সামনে রেখে সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদিও চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগে অভ্যন্তরীণ কোন্দল দীর্ঘদিনের। নগর আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন দুটি গ্রুপ বহুকাল ধরেই দুটি ধারায় বিভক্ত। মহিউদ্দিন চৌধুরী মারা যাওয়ার পর তার গ্রুপের হাল ধরেছেন তার বড় ছেলে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল।

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের গত নির্বাচনে কাউন্সিলর মনোনয়ন নিয়ে আ জ ম নাছির ও নওফেল গ্রুপের স্নায়ুযুদ্ধ প্রথমবারের মতো প্রকাশ্য রূপ নেয়। একই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ নগর আওয়ামী লীগের ইউনিট সম্মেলন চলাকালে দুই গ্রুপের অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা গেছে স্পষ্টভাবে।

গত ১৪ নভেম্বর দারুল ফজল মার্কেটের দলীয় কার্যালয়ে নগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বর্তমান কমিটিকে ‘অবৈধ’ বলার পর বাদানুবাদে জড়িত পড়েন শীর্ষ নেতারা। এ সময় সভায় উপস্থিত কয়েকজন নেতা একযোগে মেয়রের বক্তব্যের বিরোধিতা করে সভায় হট্টগোল শুরু করেন।

মাঝে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরের সঙ্গে ‘সদ্ভাব’ থাকলেও রেজাউল করিম এখন পাকাপাকিভাবে নওফেল গ্রুপে আসন গেড়েছেন— এমন প্রচার আছে বাইরে। তারই প্রকাশ ঘটে নগর আওয়ামী লীগের ওই সভায়। নগর আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটিকে অবৈধ আখ্যায়িত করে রেজাউল ওই সময় বলেন, ‘২০১৩ সালে গঠিত কমিটির মেয়াদ তিন বছর পরেই শেষ হয়েছে। এই মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি অবৈধ। এই কমিটির ওয়ার্ড, ইউনিট এবং থানায় সম্মেলন করার কোনো এখতিয়ার নেই।’ এ সময় মেয়রের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, ‘কমিটি অবৈধ হলে আপনি সভায় এসেছেন কেন?

সর্বশেষ গত ২৬ ডিসেম্বর বাগমনিরাম ওয়ার্ডের সম্মেলন শুরুর প্রাক্কালে শিক্ষা উপমন্ত্রী নওফেল বলয়ের কয়েকজন নেতা চট্টগ্রাম নগরের ইউনিট সম্মেলন নিয়ে তাদের বিভিন্ন অভিযোগ কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে তুলে ধরেন। ইউনিট কমিটি গঠনে নানা অনিয়মের অভিযোগও আনা হয়। এরপর হঠাৎ করেই কেন্দ্র থেকে ওয়ার্ড পর্যায়ের সম্মেলন স্থগিত রাখার নির্দেশ আসে।

নগর আওয়ামী লীগের সম্পাদকমণ্ডলীর একজন সদস্য চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘সম্মেলনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে নগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরীসহ বেশ কয়েকজন নেতা ঢাকায় অভিযোগ করেছেন। এর ভিত্তিতে সম্মেলনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সিনিয়র নেতাদের এই বিভাজন দূর করতে দলের সিনিয়র নেতাদের নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা একসাথে বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এরপরই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সম্মেলনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!