রাতভর হয়রানি সকালে আটক, ‘সাজানো’ ছুঁতোয় থানায় বন্দি আইনজীবী

থানার ভেতরে সালিশ বাণিজ্যের প্রতিবাদ করাই কাল হয়েছে

‘অজানা’ অভিযোগে সারারাত বাড়ি ঘেরাও করে সকালে নাটকীয়ভাবে আটক করে থানায় নেওয়া হয় চট্টগ্রাম আদালতের শিক্ষানবিশ আইনজীবী জাহিদুল ইসলামকে। আটক হওয়ার আগ পর্যন্ত ভোররাত পর্যন্ত অনন্যোপায় হয়ে ফেসবুকে বারবার স্ট্যাটাস দিয়ে থানা হাজতে তার জীবন হুমকির আশংকা আছে বলে জানান এই তরুণ আইনজীবী। সোমবার ( ১৮ মে ) ভোরে আটক হওয়ার পর থেকে তার আর কোন খবর পাওয়া যায়নি। কোন্ মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এখনও পুলিশ কাস্টডিতে আছেন কিনা বা আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে কিনা সে বিষয়েও কোন তথ্য দিতে নারাজ কুতুবদিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা দিদারুল ফেরদৌস। বারবার যোগাযোগ করেও আটক হওয়া তরুণ আইনজীবী জাহিদুল ইসলাম কোথায় আছেন সে বিষয়ে কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।

জানা গেছে, কুতুবদিয়া পুলিশের ‘সমালোচনা’ করে স্ট্যাটাস দেওয়ার পর তার বিরুদ্ধে কোনরকম অভিযোগ বা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই ‘কথিত সাইবার ক্রাইম’-এর অজুহাত দেখিয়ে সোমবার (১৮ মে) মধ্য রাতে পুরো ফোর্স নিয়ে জাহিদের বাড়িতে হানা দেয় পুলিশ। ওই সময় পুলিশ সদস্যা জাহিদের পরিবারের নারী সদস্যদেরও হয়রানি করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

ওসি দিদারুল ফেরদৌসের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ নতুন নয়। এর আগে ২০১৮ সালে ৮ আগস্ট বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি ও মিথ্যা মামলা, গ্রেপ্তার ও দখল বাণিজ্য ও উপজেলায় একচেটিয়া ত্রাস সৃষ্টি করার অভিযোগে কুতুবদিয়ার থানার ওসি দিদারুল ফেরদৌস, এসআই জয়নাল আবেদীন ও এএসআই সজল দাশের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয়ের বরাবরে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের কুতুবদিয়া শাখার সভাপতি মনোয়ার ইসলাম চৌধুরী মুকুল।

আটক হওয়া আইনজীবী জাহিদের বোন তাসনিম জানান, ‘আমরা যে রুমে বন্ধ করে ছিলাম সেটার দরজার পিলার দিয়ে ভেঙ্গে আমার ভাইকে নিয়ে গেছে। সর্বশেষ থানা থেকে জানালো ভাইকে কক্সবাজার পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। জানি না কুতুবদিয়া পুলিশ সত্য বলছে কিনা? নাকি মিথ্যা বলে থানায় রেখে আমার ভাইকে শারীরিক টর্চার করছে।’

এদিকে চট্টগ্রাম আদালতের আইনজীবীরা এ ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। তারা বলেছেন, জাহিদের যদি কোন দোষ থাকলে সেটার বিচার হোক। তবে ফেসবুক লাইভে যা দেখলাম তাতে স্পষ্টই লক্ষ্য করা গেছে পুলিশ প্রকাশ্যে আইন লঙ্ঘন করেছে। এখনও কোন মামলা হয়েছে কিনা সে তথ্য পাওয়া যায়নি। এভাবে কাউকে বিনা অভিযোগে থানায় আটক রাখা মানবাধিকারবিরোধী।

কক্সবাজার আদালতের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক আইনজীবী জানিয়েছেন, কুতুবদিয়ার ওসি দিদারুল ফেরদৌস নিজেকে জবাবদিহিতার উর্ধ্বে ভাবেন। ইতিপূর্বে বিভিন্ন ঘটনায় তার ওদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ লক্ষ্য করা গেছে। তার বিরুদ্ধে দুদকেও অভিযোগ আছে। জাহিদকে আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি কোন তথ্যই দেননি। কাল মঙ্গলবার (১৯ মে) আমরা কক্সবাজার আদালতে খোঁজ নেব। তার পরিবারও ভীষণ অনিশ্চয়তায় রয়েছে।

তারা আরও জানান, জাহিদের অপরাধটি হল কুতুবদিয়া থানায় অবৈধ সালিশ-বিচার করে ওসির টাকা কামানোর বিষয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে প্রতিবাদ করা ও স্থানীয় ভূমিদস্যুদের সরকারি খাসজমি দখলের প্রতিবাদ করা। ব্যক্তিগত রোষানলে পড়ে আইনের তোয়াক্কা না করে একজন ওসি অন্যায়ভাবে শিক্ষানবিশ আইনজীবীকে এভাবে গ্রেপ্তার করলেন। তার সাজানো ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় ফাঁসিয়ে দিলেও আমরা কিছুই করতে পারলাম না। থানায় আটকে রেখে নির্যাতন করা হলেও আমরা কিছুই করতে পারি না। এটাই দেখার বাকি ছিল হয়তো।

অ্যাডভোকেট জাহেদ সালমুন বলেন, ‘জাহিদুল ইসলাম হৃদয়কে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে বলে জেনেছি। আদালতে চালান না দিয়ে তাকে থানায় এখনও আটকে রাখা হয়েছে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করেই সে পুলিশের রোষে পড়ল। প্রতিবাদ যদি অপরাধ হয় তাহলে কেউ আর প্রতিবাদ করবে না। অবিলম্বে জাহিদকে মুক্তি এবং উচ্চ তদন্ত কমিটি গঠন করে ঘটনার প্রকৃত সত্যতা যাচাই করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবি জানাচ্ছি।’

এ বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে অ্যাডভোকেট রিগান আচার্য্য বলেন, ‘শিক্ষানবীশ আইনজীবী জাহিদকে পুলিশ কোন মামলা ছাড়াই আটক করেছে। আমরা একটু আগে খবর পেয়েছি যে তাকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিচ্ছে। আমার বক্তব্য হচ্ছে পুলিশও আইনের ঊর্ধ্বে না। কিন্তু শিক্ষানবিশ আইনজীবী জাহিদকে যেভাবে পুলিশ আটক করেছে সেটা সম্পূর্ণ আইন পরিপন্থী। যদি তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকতো বা যেকোনো মামলা হতো, তাহলে তাকে গ্রেপ্তার করা যেত। কিন্তু সারারাত ধরে তাতকে ঘরে বন্দি রেখে দরজা ভেঙে একজন দাগী আসামির মত তাকে আটক করে পরে ডিজিটাল আইনে মামলা দেওয়া সম্পূর্ণ আইনবহির্ভূত কাজ। অতি দ্রুত আমি জাহিদের মুক্তি চাই। তার কোন অপরাধ থাকলে সেটার বিচার আদালত করবে। পুলিশের এ ধরনের কাজের কারণে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে।’

অ্যাডভোকেট তারিক আজিজ জামী বলেছেন, ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া একজন শিক্ষানবিশ আইনজীবীকে বাসস্থানে গিয়ে পুলিশের হয়রানি এবং এ পর্যন্ত কোন মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে কী না বারবার যোগাযোগ করতে চেষ্টা করেও সে বিষয়ে স্পষ্ট হতে পারিনি। পুলিশের এ ধরনের নিয়মবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানাই। এ বিষয়ে উর্ধতন কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’

এ ঘটনায় ওসি দিদারুল ফেরদৌসের বক্তব্য জানতে তার অফিসিয়াল নম্বরে যোগাযোগ করা হলে থানায় দায়িত্বরত অন্য অফিসার ফোনটি রিসিভ করে এ বিষয়ে কোন তথ্য দিতে অপারগতা জানিয়ে ফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করে দেন। এরপরে কল করা হলেও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।

এদিকে কুতুবদিয়া থানার বিতর্কিত ওসি দিদারুল ফেরদৌসের বিরুদ্ধে দুদকে থাকা অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক জেলা সমন্বিত কার্যালয় চট্টগ্রাম ২ এর এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কুতুবদিয়ার ওসি ও বেশ কয়েকজন সেখানকার পুলিশ কর্মকর্তা ও সেখানকার এক ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের অনুসন্ধান শেষে তদন্ত রির্পোট কমিশন বরাবরে দাখিল করা হয়েছে।’

এসএস/সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!