রাতদিন পানিবন্দি পতেঙ্গার কাটগড়, মূলে ভারটেক্সের ডিপো

চট্টগ্রামের পতেঙ্গা কাটগড় এলাকায় পরিকল্পিত জলাবদ্ধতার সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছে ভারটেক্স কনটেইনার ডিপো নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এলাকাবাসী ছাড়াও স্থানীয় কাউন্সিলরের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানটির স্বেচ্ছাচারিতার কারণে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের পশ্চিম কাটগড় হিন্দুপাড়ার এক ও দুই নম্বর গলিতে বসবাসরত প্রায় ১০ হাজার স্থানীয় বাসিন্দাকে বছরের পর বছর ধরে সামান্য বৃষ্টিতেই পানিবন্দি থাকতে হয়। বর্ষার মৌসুম ছাড়াও প্রতি শুক্রবার বাসাবাড়ির ব্যবহৃত পানির কারণে হিন্দু পাড়ার ছোট-বড় সব গলিতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। ফলে এলাকাবাসীর হাঁটাচলাই দায় হয়ে পড়েছে।

৯ সেপ্টেম্বর সকালে সরেজমিনে পূর্ব কাটগড় হিন্দু পাড়ায় গেলে চোখে পড়ে সামান্য বৃষ্টিতেই একাধিক গলিতে পানি জমে আছে। ভুক্তভোগীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ভারটেক্স কোম্পানির কাছে আমরা আর কত বছর ধরে এভাবে জিম্মি থাকব?

জানা যায়, গত ১০ জুন ভারটেক্স কোম্পানি মূল ড্রেন বন্ধ করে দিলে এলাকায় জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করে। জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পেতে ভারটেক্স কনটেইনার ডিপোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে লিখিত অভিযোগ করেন এলাকাবাসী। গত ১৫ জুলাই সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, ওই এলাকার সংসদ সদস্য এমএ লতিফ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এবং ২৮ জুলাই চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ দেওয়া হয়। এছাড়া চট্টগ্রাম পুলিশ কমিশনার, স্থানীয় কাউন্সিলর ও পতেঙ্গা মডেল থানাকেও জানানো হয় বিষয়টি।

লিখিত অভিযোগে বলা হয়, কাটগড় এলাকায় ভারটেক্স লজিস্টিকস লিমিটেড প্রায় ২০ কানি জমির ওপর তাদের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। চারদিকে সীমানা প্রাচীর গড়ে তোলায় কারখানার ভেতরে আদৌ পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা আছে কিনা তাও দৃশ্যমান নয়। ডিপোর ভেতর যে ড্রেন আছে তা নামমাত্র। জানা যায়, এলাকাবাসীর ক্ষোভ কমাতে এর আগে ভারটেক্স কনটেইনার ডিপো কর্তৃপক্ষ এলাকাবাসীকে জলজট নিরসনে উদ্যোগ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু তা ছিল লোকদেখানো। পানি নিস্কাশনের স্থায়ী সমাধানে ডিপোর মালিকপক্ষের সঙ্গে এলাকাবাসীর একাধিকবার বৈঠকের পরও সমস্যার স্থায়ী কোন সমাধান হয়নি।

এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা ৪০ ও ৪১ নং ওয়ার্ড হিন্দু বৌদ্ধ ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ওয়ার্ড প্রতিনিধি রতন কুমার তালুকদার চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে জানান, ‘কাটগড় হিন্দুপাড়ায় জলাবদ্ধতার জন্য একমাত্র ভারটেক্স কনটেইনার ডিপো দায়ী। যত সমস্যা ফিসকোর (ভারটেক্সের পূর্ব নাম) জন্য। অতীতে কাটগড় হিন্দু পাড়ায় টানা বর্ষণেও জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতো না। কারণ বৃষ্টির পানি সরাসরি গুপ্ত খালের শাখা খালে গিয়ে মিশে কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়তো।’

রতন কুমার তালুকদার বলেন, ‘বর্তমানে একদিকে যেমন গুপ্ত খালের শাখা খাল অবৈধভাবে দখল ও ভরাট হয়ে গেছে। অন্যদিকে ভারটেক্স কনটেইনার ডিপো বিশাল জায়গা দখল করে আছে। তাদের কৌশলগত কারণে সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। ভারটেক্স কর্তৃপক্ষ প্রভাবশালী। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে গেলে মামলা-হামলার শিকার হতে হবে বলে হুমকি দেয়। জলাবদ্ধতা নিরসনে চট্টগ্রাম ১১ আসনের সাংসদকে লিখিত অভিযোগ করলে তিনি চিটাগাং চেম্বার অব কমার্সে উভয়পক্ষের বৈঠক ডাকেন। বৈঠকে ভারটেক্স মালিক পক্ষ আমাদের দাবি পূরণের আশ্বাস দিলেও তারা কথা রাখেনি।’

ওয়ার্ড প্রতিনিধি ও মহল্লা কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি ইয়ার মোহাম্মদ বলেন, ‘দায়িত্ববানদের কাছে অভিযোগ করার পরেও কোন সুফল মেলেনি। ড্রেন সংস্কার ও খাল রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে পানি নিষ্কাশনের পথ। ফলে জলাবদ্ধতা আজ জনদুর্ভোগের অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে পূর্ব কাটগড়বাসীর। ভারটেক্স কর্তৃপক্ষ কাটগড় এলাকায় জমি অধিগ্রহণের সময় জলাবদ্ধতা নিরসনে পরিকল্পিত কোন ড্রেনেজ ব্যবস্থা রাখেনি। ভারটেক্স গড়ে ওঠার আগে জমির মধ্য দিয়ে এলাকাবাসীর তৈরি করা ড্রেন দিয়ে পানি সরাসরি খালে গিয়ে পড়ত। বর্তমানে ভারটেক্স কোম্পানি সেই ড্রেন বন্ধ করে দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানোর পরেও জানি না কোন্ অদৃশ্য শক্তির কারণে বিষয়টি এখনও নজরে আসছে না সংশ্লিষ্টদের?’

তিনি বলেন, ‘ভারটেক্স মালিক পক্ষের ফাহিম ইমরান নূরের সাথে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। তিনি আশ্বস্ত করেছেন। কিন্তু কাজ করেন উল্টো। তিনি কথা রাখেননি। ভারটেক্সের কারণে আমরা প্রতিনিয়ত জলজটের মধ্যে বসবাস করি।’

ভারটেক্স লজিস্টিক লিমিটেডের নির্বাহী পরিচালক আবদুর রহমান মুঠোফোনে চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘কাউন্সিলর এবং এলাকাবাসীর অভিযোগ মিথ্যা। কাটগড় হিন্দুপাড়ায় জলজটের বিষয়ে ভারটেক্স কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়। কিছুদিন আগে আমি বিষয়টি জানতে পেরে জলাবদ্ধতা নিরসনে আমার প্রতিনিধিদের সরজমিনে পাঠালে তারা দেখতে পায়, বসবাসের জন্য অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা ভবন নির্মাণের কারণেই এই জলাবদ্ধতা।’

ওয়ার্ড কাউন্সিলর জয়নাল আবেদীন চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে বলেন, ‘পূর্ব কাটগড় এলাকায় হিন্দুপাড়ার ১-২ নম্বর গলিতে জলজটের বিষয়ে ভারটেক্স কর্তৃপক্ষ দায়ী বলে আমি মনে করি। ড্রেন সম্প্রসারণের জন্য আমি তাদের কোন সহযোগিতা পাইনি। ভারটেক্স কর্তৃপক্ষ পানি নিষ্কাশনের জন্য বিন্দুমাত্র কোন জায়গা ছাড় দেয়নি।’

ওয়ার্ড কাউন্সিলর বলেন, ‘অতীতে প্রচুর বৃষ্টি হলেও পূর্ব কাটগড় আরব আলী দোকান ও হিন্দু পাড়া এলাকায় কখনও পানি জমতো না। বৃষ্টির পানি সরাসরি গুপ্ত খালের শাখা খালে গিয়ে মিশে কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়তো। সেই খাল এখন ভরাট ও অবৈধ দখলদারদের হাতে জিম্মি। এলাকার বৃহত্তর স্বার্থে ভারটেক্স কনটেনার ডিপো কর্তৃপক্ষ এলাকাবাসীর সাথে সমন্বয় করে কাজ করলে জলজটের সমাধান হতো।’

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!