রাজা-বাদশা-ডনরা চট্টগ্রামে গরুর বাজার কাঁপাচ্ছে, বাহারি সব গরুর আগুনে দাম

নাম যুবরাজ। ভাবেসাবে রাজকীয়, তবে চুপচাপ। তাকে আনা হয়েছে ফরিদপুর জেলার মধুখালী থানার কাটাখালী থেকে। ব্যাপারি আক্কাছ শেখ তিন বছর লালনপালন শেষে যুবরাজকে বিক্রি করতে নিয়ে এসেছেন চট্টগ্রাম নগরীর মুরাদপুরের বিবিরহাটে। আক্কাছ বেপারি গরুটির দাম হাঁকছেন ৫ লাখ টাকা।

এর পেছনে যুক্তি দিতে গিয়ে তিনি জানালেন, যুবরাজের দিনে খরচ হয় ৬০০ টাকা। গরুটি খায় ১২ কেজি ভূষি, খুঁদ ৩ কেজি, ঘাস ১০০ টাকার, খড় খায় ৫০ টাকার। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসে যুবরাজ অনেকটাই ক্লান্ত। যুবরাজ খায় আর ঘুমায়— বললেন আক্কাছ শেখ।

মুরাদপুর বিবিরহাটের কোরবানি পশুর হাটে যুবরাজের মতোই বাজার আলো করে বসে আছে বাহারি সব নামের গরু। ডন, রাজা বাদশা, সাহেব আলী, বীরবিক্রম, রাজকুমারসহ বিভিন্ন নামের বড় গরুতে এই বাজার ভরা। প্রতিদিনই সেখানে ট্রাকে করে আসছে গরু দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত এই হাটে তিন হাজারের মতো গরু এসেছে এ পর্যন্ত।

বৃহস্পতিবার (১৫ জুলাই) গরুর হাটটি ঘুরে দেখা গেছে, হাটে বড় গরুই বেশি। ব্যাপারিরা বেশি দামে বিক্রি ও লাভের আশায় হাটে বড় বড় গরু নিয়েই এসেছেন। মাঝারি ও ছোট সাইজের গরু থাকলেও সংখ্যায় সেগুলো কম। ছাগলের দামও হাঁকা হচ্ছে বেশি। মাঝারি সাইজের একটা ছাগলের দাম হাঁকা হচ্ছে ২৪ হাজার টাকা।

তবে এতোকিছুর পরও হাটে ক্রেতাসমাগম এখনও অনেকটাই কম। বেশিরভাগ ক্রেতাই এসে দরদাম করে চলে যাচ্ছেন। গরুর ব্যাপারিরা বলছেন, হাট জমতে আরো দুই-একদিন লাগবে। গরু আনতে ট্রাক ভাড়া, ডোগা খরচ, থাকা-থাওয়ার খরচ, গরুর খাবারে বাড়তি টাকা লেগেছে এ বছর। তাই তারা বাধ্য হয়েই গরুর দাম বেশি হাঁকছেন।

হাটের মধ্যেই ব্যাপারিদের নাওয়া-খাওয়া চলছে। ৭-৮ জন মিলে বড় ডেকচিতে ভাত-তরকারি রান্না করে গোল হয়ে বসে ভোজনপর্ব সারছেন। গরুর ডোগার উপর মাচা বেঁধে সেখানেই ব্যাপারিরা ঘুম ও বিশ্রাম নিচ্ছেন।

জানা গেছে, এবারের হাটে প্রতি ব্যাপারিকে ‘ডোগা খরচে’ ৫০ হাজার টাকা করে দিতে হয়েছে। ফরিদপুর, মাগুরা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও কুষ্টিয়া থেকে ব্যাপারিরা বেশি এসেছেন বিবিরহাটের পশুর হাটে।

বিবিরহাটের বাজারে ১২ মণ ওজনের ‘শান্ত’ এসেছে মাগুরা জেলার শ্রীপুর থানার নারকোল গ্রাম থেকে। গরুটির মালিক হাতেম শেখ জানান, ‘এ গরু শান্ত স্বভাবের। খায় আর ঘুমায়। সেজন্য নামও রেখেছি শান্ত।’

হাটের মধ্যেই ব্যাপারিদের নাওয়া-খাওয়া চলছে।
হাটের মধ্যেই ব্যাপারিদের নাওয়া-খাওয়া চলছে।

শান্তর দাম হাঁকা হচ্ছে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। হাতেম শেখ মোট ১৬টি গরু বিক্রির জন্য চট্টগ্রাম নিয়ে এসেছেন। দেড়লাখ টাকা থেকে শুরু করে সাড়ে তিন লাখ টাকা দামের গরু রয়েছে তার কালেকশনে। তবে হাতেম শেখ এবার সতর্ক বেশ। গতবার তিনি হাটে আনা সব গরু বিক্রি না হওয়ায় ২ লাখ টাকা ক্ষতির মুখে পড়েছিলেন।

কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার শাহেনুর রহমান শাহিন ‘রাজা-বাদশা’ নামের একটি গরুর জন্য দাম চাইছেন তিন লাখ টাকা। দুই ভাই মিলে তারা মোট ১৩টি গরু এনেছেন বিবিরহাটে। বাড়ির পাশের একজনের কাছ থেকে বাছুর কিনে ২ বছরে এত বড় করে তুলেছেন। শাহিন জানান, রাজা-বাদশার স্বভাবও রাজা বাদশার মতোই। তাকে বাসি কোনো খাবার দিলেই তার পেট খারাপ হয়। সবচেয়ে ভালো মানের ভূষি খাওয়াতে হয় তাকে।

শাহিন জানান, গমের ভূষি ১০ কেজি, চালের গুঁড়ো বা আটা ১০ কেজি, খুদের ভাত ৬ কেজি করে দুইবেলা করে খড় খায় ‘রাজা-বাদশা’। প্রতিদিন এই গরুর পিছনে তার ৪০০ টাকা খরচ হয়।

রাজা-বাদশাহর পাশেই দেখা গেল ‘সাহেব আলী’কে। তার মালিক রাজ্জাক ব্যাপারি ‘সাহেব আলী’র দাম চাইছেন ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। ফরিদপুরের মহেশপুর থেকে ছোট-বড় মিলিয়ে নয়টি বড় গরু এনেছেন তিনি। দেড় লাখ থেকে শুরু করে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা দামের গরুও তার কালেকশনে।

ওদিকে পলাশ ব্যাপারি মাগুরা শ্রীপুর থেকে আনা বড় এক গরুর দাম হাঁকছেন ২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর থেকে আসা আরেক ব্যাপারি ২৫টি গরু নিয়ে চট্টগ্রামে এসেছেন বিক্রি করতে। দাম ৭০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত।

মাগুরা শ্রীপুরের ব্যাপারি নান্নু বিশ্বাস ১৬টি গরু এনেছেন হাটে। যার মধ্যে একটি গরুর নাম— বীরবিক্রম। দাম ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। অনান্য গরুর দাম ৮০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত।

হাশেম ব্যাপারি ‘রাজকুমার’ নামেই বড় এক গরুর দাম হাঁকছেন ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। তিনিও কুমারখালী থেকে ১৬টি গরু এনেছেন বিবিরহাটে। ২২ বছর ধরে গরুর ব্যবসা করে আসা হাসেম ব্যাপারি বললেন, ‘এবারে ওপরওয়ালা কী রেখেছে কপালে— লাভ হবে নাকি লস হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’

জানা গেছে, চট্টগ্রামের অন্যতম প্রধান পশুর বাজার বিবিরহাটে এবার দেশি জাতের গরুর পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ান ও বলদ প্রজাতির গরুরই বেশি এসেছে। ব্যাপারিরা সাধারণ মানের দেশি গরুর দাম হাঁকছেন ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা।

বিবিরহাটের বাসিন্দা পারভেজ বিক্রির জন্য সিরাজগঞ্জ থেকে নিয়ে এসেছেন ১০টি গরু। গরুগুলোর নাম দিয়েছেন— বিবিরহাটের ডন। নামের কারণ ব্যাখা করতে গিয়ে তিনি বলেন, বিবিরহাটের কোনো ব্যাপারিই তার মতো বড় গরু আনতে পারেননি। তাই ‘ডন’ নামেই ডাকা হচ্ছে তার গরুদের। পারভেজ প্রতি ‘ডন’ গরুর দাম হাঁকছেন সাড়ে ৩ লাখ টাকা। দুটো মিলিয়ে দাম চাইছেন ৫০ হাজার কম— ৭ লাখ টাকা।

দাম কেন এতো বেশি— এমন প্রশ্নের উত্তরে পারভেজ বলেন, ‘বিবিরহাটের ডনদের বিশেষ যত্ন নেওয়া হচ্ছে। যেমন আমি সানসিল্ক শাম্পু দিয়ে আমার গরুদের গোসল করাই। প্রতি গরুকে ১২ পিস ওরস্যালাইন খাওয়াচ্ছি প্রতিদিন। ভালো মানের ভুষি ও ছোলা খাওয়াচ্ছি ডনদের। আর যাতায়াত খরচেও গেছে অনেক টাকা। সব মিলিয়ে গরুপ্রতি একটা নির্য়েষ্ট অংকের লাভ না হলে পথে বসতে হবে।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে আসা দেশি দশলা প্রজাতির গাই গরু বিক্রি হচ্ছে বিবিরহাটে। দাম দেড় লাখ থেকে ৪ লাখ টাকা। ব্যাপারি শরীফ জানান, তিন বছর ধরে তার গরুগুলোকে পালন করা হয়েছে। তবে চট্টগ্রামে এসে গরমে সমস্যা হচ্ছে গরুগুলোর। বারবার শোয়া থেকে গরুগুলো উঠে দাঁড়াচ্ছে। ছেলেকে স্ট্যান্ড টেবিল ফ্যান কিনতে বাজারে পাঠিয়েছেন তিনি।

বিবিরহাটে অন্যরকম এক ব্যাপারির দেখা মিলল। নাম মঈনুদ্দিন হাসান। সবাই ডাকেন লালা ভাই। ছিলেন ব্যাংকার। আড়াই বছর আগে ব্যাংকিং পেশা ছেড়ে গরুর খামারের দিকে ঝুঁকে পড়েন। চট্টগ্রাম শহরে থাকলেও ফটিকছড়ির নাজিরহাটে গড়ে তুলেছেন বিছমিল্লাহ এগ্রো ফার্ম। প্রথমে ২০টি দিয়ে শুরু করলেও এখন তার গরুর সংখ্যা ৪৭টি। সেই ৪৭টি গরুই তিনি হাটে এনেছেন বিক্রি করতে। নিজেই ক্রেতাদের সাথে দরদাম করছেন। বড় গরু বিক্রির জন্য দাম হাঁকছেন ৬ লাখ টাকা। তবে সাড়ে চার লাখ পেলেই ছেড়ে দেবেন— বলছেন এই কথাও। আর ছোট গরুগুলো ৫ লাখ টাকা দাম হাঁকলেও বিক্রি করতে চান ২ লাখ ৭০ হাজার টাকায়। তার গরুগুলো শাহীওয়াল পাকিস্তানি জাতের— জানান লালা।

গরুর পাশাপাশি হাটের সামনে প্রবেশমুখের কাছে বিক্রি হচ্ছে ছাগল। রহমান নামে স্থানীয় এক যুবক ১৭৫টি ছাগল এনেছেন বিক্রির জন্য। তারা ৫ বন্ধু মিলে এ ছাগলগুলো কিনে এনেছেন। ৭ হাজার টাকা থেকে ২৭ হাজার টাকা পর্যন্ত দামের ছাগল তাদের কাছে রয়েছে— জানান রহমান। রয়েছে ৩৫ হাজার টাকার ছাগলও।

তবে সবমিলিয়ে গরুর কালেকশন বেশ ভালো হলেও বিবিরহাটে ক্রেতাদের আনাগোনা এখনও কম। যারা আসছেন, তারা এসে দরদাম করেই চলে যাচ্ছেন বলে জানান বিক্রেতারা।

সিমেন্ট ব্যবসায়ী আজগর আলী জানালেন, তিনি তিনটি গরু কেনার জন্য হাটে এসেছেন। কিন্তু গত বছরের চেয়ে এবার দাম অনেক বেশি। এত দাম হলে তো অন্য হাট আরও ঘুরে দেখতে হবে। না পাওয়া গেলে তিনটের বদলে দুটো গরুই কিনবেন— জানালেন এই ব্যবসায়ী।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পরিচালিত বিবিরহাটের এ গরুর বাজারের ডোগা ও বিট মালিক সোহেল রেজা। চট্টগ্রাম প্রতিদিনকে তিনি বলেন, হাটে তিন হাজারের মতো গরু এসেছে এ পর্যন্ত। খুঁটি বা ডোগা আছে ৮৬টি। গরুর তুলনায় জায়গা কম হওয়ায় প্রতি ডোগাতে ৩-৪টি করে গরু রাখা হচ্ছে। ব্যাপারি বাবদ ৫০ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়েছে বলে জানান সোহেল। গরু ও ব্যাপারিদের নিরাপত্তার জন্য সার্বক্ষণিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কাজ করছে বলে জানান তিনি।

সিপি

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!