রাজস্থলীর ৩ খুন, হাত বেঁধে মাথায় গুলি করা হয় ওদের

দুপক্ষের বন্দুকযুদ্ধে নয়। হাত পেছনে বেঁধে ঠাণ্ডা মাথায় কাছ থেকে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে তাদের। রাঙামাটির রাজস্থলীতে উদ্ধার হওয়া তিন জনের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে এমনটাই জানিয়েছে পুলিশ।

নিহতরা হলেন বান্দরবান জেলার সদর উপজেলার রাজভিলা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ৮ নম্বর নোয়াপাড়া গ্রামের কার্বারি (গ্রাম প্রধান) মোনারাম তঞ্চঙ্গ্যা (৪৬) তার ছেলে আদর তঞ্চঙ্গ্যা (২২) প্রকাশ সুখমনি এবং একই গ্রামের বাসিন্দা উসিমং মারমা (২৫)।

সোমবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে উপজেলার গাইন্দ্যা ইউনিয়নের বালুমুড়া পাহাড়ি গ্রামে তিন জনকে হত্যা করে অস্ত্রধারিরা। ওই এলাকায় রাস্তার পাশে তিন জনের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখতে পান স্থানীয়রা। পরে রাজস্থলী থানা পুলিশে খবর দেন। তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থল গিয়ে একটি এলজিসহ মরদেহ তিনটি উদ্ধার করে পুলিশ ও নিরাপত্তাবাহিনীর যৌথ দল। একইদিন বিকেলে তাদেরকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করা হয়েছিল।

মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) দুপুরে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে তিনটি মরদেহের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু নিহতদের মরদেহ কেউ দাবি না করায় রাঙামাটি পৌরসভার কাছে ‘বেওয়ারিশ’ হিসেবে মরদেহ হস্তান্তর করে পুলিশ। পরে বিকেলে আইনী আনুষ্ঠানিকতা শেষে মরদেহ সৎকার করে পৌরসভা কর্তৃপক্ষ।

তবে সোমবার (১৮ নভেম্বর) সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত থানায় এ বিষয়ে কেউ অভিযোগ দিতে আসেনি। এমনকি নিহতদের মরদেহও কেউ দাবি করেনি। তবে কেউ বাদি না হলে পুলিশ নিজেই বাদি হয়ে হত্যা মামলা করবে বলে জানিয়েছেন রাজস্থলী পুলিরে উপ-পরিদর্শক শাহ আলম।

মরদেহ তিনটির ময়নাতদন্তের দায়িত্বে থাকা এ কর্মকর্তা গতকাল বিকেলে এমন তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আইনী আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে তথ্য-উপাত্ত সিআইডিতে পাঠানো হবে।’

রাঙামাটি পৌরসভার প্যানেল মেয়র মো. জামাল উদ্দিন বলেন, ‘বেওয়ারিশ হিসেবে ওই তিন জনের লাশ হস্তান্তর করেছে রাজস্থলী থানা পুলিশ। মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) বিকালে পৌরসভার উদ্যোগে স্থানীয় শ্মশানে লাশ তিনটির শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়েছে।’

এদিকে নিহত তিন জনকে জেএসএস সদস্য বলা হলেও তা অস্বীকার করে সংগঠনটির পক্ষে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নিহতরা তাদের দলের কেউ নন এবং তারা বান্দরবানের রাজভিলা এলাকার নিরীহ গ্রামবাসী। আরাকান লিবারেশন পার্টির সন্ত্রাসীরা নৃশংসভাবে গুলি করে ওই তিন জনকে হত্যা করেছে।

এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির ‘সশস্ত্র দু’গ্রুপের’ মধ্যে সংঘটিত ঘটনা বলা হলেও তা অস্বীকার করে সংগঠনটির পক্ষে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নিহতরা তাদের দলের কেউ নন এবং তারা বান্দরবানের রাজভিলা এলাকার নিরীহ গ্রামবাসী। স্থানীয় ‘মগপার্টি’ হিসেবে পরিচিত আরাকান লিবারেশন পার্টির (এএলপি) সন্ত্রাসীরা নৃশংসভাবে গুলি করে ওই তিনজনকে হত্যা করেছে।’

মঙ্গলবার পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির রাঙামাটি জেলা কমিটির তথ্য ও প্রচার সম্পাদক নগেন্দ্র চাকমা গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে এ দাবি করেছেন।

সোমবার রাজস্থলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মফজল আহাম্মদ খান বলেন, ‘আমরা প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি নিহতরা সকলেই জেএসএসর রাজনীতির সাথে জড়িত।’

উপজেলাটিতে গত ৭ মাসে ১টি জোড়াখুন, এক সেনাসদস্য ও এক যুবলীগ নেতাসহ ১০ জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ সোমবার তিনজনকে হত্যার ঘটনা ঘটলো।

এর আগে ২৩ অক্টোবর রাজস্থলী উপজেলা বিএনপির সহ-সভাপতি ও ঘিলাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়্যারম্যান দীপময় তালুকদার খুন করে সন্ত্রাসীরা। আগেরদিন বিকালে তাইতং পাড়াস্থ জিরো মাইল এলাকা থেকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে নিয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। দীপময় ও ৩৩৩ নম্বর ঘিলাছড়ি মৌজার হেডম্যান দায়িত্বও পালন করছিলেন। ওই ঘটনাতেও খুনিদের শনাক্ত ও হত্যাকাণ্ডের কারণ জানাতে পারেনি পুলিশ।

জনসংহতি সমিতির বিবৃতি- ওই ঘটনায় বিভিন্ন সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) রাঙামাটি জেলা শাখার তথ্য ও প্রচার সম্পাদক নগেন্দ্র চাকমা। সংবাদ মাধ্যমে দেওয়া এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, বিভিন্ন সংবাদে কোনো বস্তুনিষ্ট তদন্ত ও বাছ-বিচার ছাড়া নিরাপত্তা বাহিনী, পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের বরাত দিয়ে একতরফাভাবে বলা হয় যে, রাঙামাটি জেলার রাজস্থলী উপজেলার গাইন্দা ইউনিয়নের বালুমুড়া মারমা পাড়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সশস্ত্র দুই গ্রুপের বন্দুকযুদ্ধে জেএসএসের ৩ সশস্ত্র কর্মী বা কোনো কোনো সংবাদের ভাষ্যে সশস্ত্র সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে। বস্তুত জনসংহতি সমিতির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের সংবাদ মিথ্যা, বানোয়াট, বিকৃত ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য-প্রণোদিত।

প্রকৃত ঘটনা হল- ১৮ নভেম্বর সকালে দলচ্যুত আরাকান লিবারেশন পার্টির (এএলপি) একটি গ্রুপ অস্ত্র-শস্ত্রসহ মদ্যপ অবস্থা বান্দরবান জেলার সদর উপজেলার রাজভিলা ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ৮ নম্বর নোয়াপাড়া গ্রামে প্রবেশ করে। প্রবেশ করেই তারা এলাকার যুবক ও পুরুষদের ধরপাকড় শুরু করে এবং তাদেরকে মারপিট করতে থাকে। শেষে বিকাল ৪টায় নোয়াপাড়ার কার্বারি (গ্রাম প্রধান) মোনারাম তঞ্চঙ্গ্যা, তার ছেলে সুখমণি (শুক্রমনি) তঞ্চঙ্গ্যা ওরফে আদরসহ চার গ্রামবাসীকে অস্ত্রের মুখে ধরে নিয়ে যায়। তাদের মধ্যে একজনকে ছেড়ে দিলেও মোনারাম তঞ্চঙ্গ্যা ও সুখমণি তঞ্চঙ্গ্যাসহ বাকি তিনজনকে সন্ধ্যার দিকে গাইন্দা ইউনিয়ন ও রাজভিলা ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী বালুমুড়া স্থানে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।

জেআর/এএইচ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!