রাঙ্গুনিয়ার ১২ ইউনিয়নে ১৫০ ইটভাটা, চলছে ‘ম্যানেজ’ করে

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া এখন ইটভাটার জঞ্জালে পরিণত হয়েছে। এ উপজেলায় গড়ে ওঠা ৯০ ভাগ ইটভাটাই অবৈধ। এসব ইটভাটায় নেই কোনো বৈধ কাগজপত্র। প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে ‘ম্যানেজ’ করে চলছে ইটভাটাগুলো।

জানা গেছে, চট্টগ্রাম পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের মধ্যে ১২টি ইউনিয়নেই রয়েছে ১৫০ ইটভাটা। শুধুমাত্র রাজানগর, দক্ষিণ রাজানগর এবং ইসলামপুর ইউনিয়নে রয়েছে ১১৩টি ইটভাটা। বেশিরভাগ ইটভাটা গড়ে উঠেছে পাহাড়ের পাদদেশে। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ ইটভাটায় নেই কোনো বৈধ কাগজপত্র। এসব ইটভাটায় বছরে পুড়ছে শত কোটি টাকার কাঠ। ইট তৈরির কাজে ব্যবহারের জন্য যত্রতত্রভাবে মাটি কাটায় বিরাণ ভূমিতে পরিণত হচ্ছে রাঙ্গুনিয়ার সংরক্ষিত বন ও পাহাড়। এতে প্রাকৃতিক বনজসম্পদ ধ্বংসের পাশাপাশি ক্রমশ পরিবেশ হারাচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য।

অভিযোগ রয়েছে অবৈধ ইটভাটাগুলোর মালিকরা সংশ্লিষ্ট প্রশাসন, বন বিভাগ, পুলিশ, বনবিট অফিস, জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের ম্যানেজ করে সংরক্ষিত ও অশ্রেণিভুক্ত বন থেকে শতকোটি টাকার কাঠ কেটে নিয়ে যাচ্ছে ইটভাটায়।

উপজেলার বিভিন্ন ইটভাটায় গিয়ে দেখা যায়, প্রায় দেড়শ ইটভাটায় ইট পোড়ানোর কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সব ভাটায় কয়লার পরিবর্তে অবৈধ জ্বালানি কাঠের অবাধে ব্যবহার চলছে। প্রত্যেক ভাটায় মজুদ রাখা হয়েছে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি কাঠ।

এদিকে অবাধে কাঠ পোড়ানোর উৎসবকে কেন্দ্র করে রাঙ্গুনিয়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে পাচারকারী ও চোরাই জ্বালানি কাঠের ব্যবসা। সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং সামাজিক বনায়নের বাগান উজাড় করে তৈরি করা হচ্ছে জ্বালানিকাঠ। অসাধু বন কর্মকর্তদের যোগসাজশে বিভিন্ন স্থানে ডিপোতে মজুদ করে সেখান থেকে কাঠ যাচ্ছে ইটের ভাটায়।

বিশেষ করে কাপ্তাইয়ের কর্ণফুলী রেঞ্জের আড়াছড়ি, চিৎমরম, রামপাহাড়, সীতাপাহাড় এবং কাপ্তাই পাল্পউড বনবিভাগের রাজস্থলী, বান্দরবান, বনাঞ্চলের বাগানের বৃক্ষ জ্বালানি কাঠ করে সরফভাটার মিরেরখীল, ভূমিরখীল, রাইখালী, কোদালা, পূর্ব কোদালা, শিলক থেকে কাঠ এসে কর্ণফুলী নদীর তীরে এবং চন্দ্রঘোনা দেওয়ানজীরহাট খেয়াঘাটের কাছে প্রকাশ্যে মজুদ করে গড়ে তোলা হয়েছে চোরাই জ্বালানি কাঠের বড় বড় ডিপো। ডিপোগুলো থেকে চাঁদের গাড়িতে করে চোরাই জ্বালানি কাঠ পাচার করা হচ্ছে উপজেলার বিভিন্ন ইটভাটায়।

অন্যদিকে প্রতিটি ইটভাটায় যে পরিমাণ ইট উৎপাদন হয়, সে অনুযায়ী সরকারি ভ্যাট পরিশোধ হচ্ছে না। ফলে সরকার হারাচ্ছে বিশাল অংকের রাজস্ব।

বিশেষ করে উপজেলার ১ নম্বর রাজানগর, দক্ষিণ রাজানগর, ইসলামপুর, হোচনাবাদের নিশ্চিন্তাপুর, লালানগরের শনখোলা বিল, চন্দ্রঘোনা ইউনিয়নে ইটভাটা স্থাপনের নীতিমালা না মেনে স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও পাহাড়বেষ্টিত এলাকায় ভাটা স্থাপন করে সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন সংরক্ষিত পাহাড় থেকে স্কেভেটর দিয়ে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে ইটভাটায়। ফলে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে অবৈধভাবে গড়ে উঠা এসব ভাটার বিষাক্ত ধোয়ায় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ। এমনকি ইটভাটার পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় অনেকে বসতবাড়ি ছেড়ে অন্যত্রে বসবাস করতে বাধ্য হচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইটভাটার এক মালিক বলেন, ‘প্রশাসন, বন বিভাগ, পুলিশ ফাঁড়ি, বিট অফিসসহ আরও কয়েকটি দপ্তরকে ম্যানেজ করে ইটভাটাগুলো পরিচালিত হচ্ছে। পত্রিকায় লেখালেখি করলে প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কিছু জরিমানা আদায় করবে। এছাড়া কোনো ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়ার নজির নেই।’

ইসলামপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা আবুল খায়ের বলেন, ‘অপরিকল্পিতভাবে ইটভাটা স্থাপন ও ট্রাকযোগে ইট পরিবহনের কারণে ধুলায় পরিবেশ বিষণ্ণ হয়ে উঠেছে। স্থানীয় বাসিন্দা ও শিক্ষার্থীরা ইটভাটার ধুয়া ও ধুলোবালিতে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রশাসন এ অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ না করলে অচিরেই মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে।’

রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ মাসুদুর রহমান বলেন, ‘ইট ভাটার সংখ্যা ও সঠিক তথ্য আমার অফিসে নেই। ইটভাটার অনুমতি ও ছাড়পত্র দেওয়া জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এখতিয়ার। তবে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য ইটের ভাটায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত আছে। গত ২২ জানুয়ারি কাঠ পোড়ানোর দায়ে ৫ ইটভাটাকে আড়াই লাখ টাকা জরিমানা করেছি এবং অবৈধ ইটভাটা বন্ধে শীঘ্রই অভিযান চালানো হবে বলেও জানা তিনি।’

এমএএম/এএইচ

যখনই ঘটনা, তখনই আপডেট পেতে, গ্রাহক হয়ে যান এখনই!