সারি সারি মালটা গাছ। থোকায় থোকায় ঝুলছে এসব। যতটুকু চোখ যায় মাল্টা আর মাল্টা। উঁচু-নিচু টিলার ভাজে ভাজে গাছগুলো দেখলেই চোখ জুড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে জুড়াবে মনও। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় ৫ একর জমিতে এই মাল্টা বাগান করেছেন সিরাজুল করিম বিপ্লব।
বিদেশ থেকে আমদানি করা ফরমালিন কিংবা রাসায়নিক মেশানো মাল্টায় যখন আস্থা হারিয়েছে মানুষ, ঠিক তখন রাঙ্গুনিয়ায় মাল্টা চাষ করা হয়েছে এমনভাবে যার উপর আস্থা রাখা যায়। কারণ প্রাকৃতিকভাবেই কোনো রাসায়নিক ছাড়াই এখানে চাষ করা হচ্ছে দেশীয় এই মাল্টা।
শুধু কি মাল্টা? এই বাগান সাজানো হয়েছে আম, লিচু, পেয়ারা ও পেঁপে গাছ দিয়েও। আমের বাগানে গেলেই দেখা মিলবে আম্রপালি, রাংগোয়াই, মল্লিকা, হাঁড়িভাঙা নানা জাতের আমের। তবে আম্রপালি ও রাংগোয়াই বেশি।
আবার বাগানের পশ্চিম পাশে ৩ একর জমিতে মিশ্র ফলের বাগান। সেখানে আপেলকুল, কমলা, জাম, লিচু, কলা, কাঁঠাল, আনারস, আমলকি, জামরুল, আতা, ডালিম, নাশপাতি, চালতা, কামরাঙ্গা, জলপাই, লেবু, পেঁপে, সাজিনা। এছাড়া আংগুর, থাই বাতাবী লেবু, চায়না কমলা, চায়না লিচু, চায়না পেয়ারা। মশলার মধ্যে সাদা এলাচ, তেজপাতা, পোলাও পাতা।
ঔষধি গাছের মধ্যে কালোমেঘ, তুলসি, আলোভেরাসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি গাছ রয়েছে তার বাগানে। চট্টগ্রাম -কাপ্তাই সড়ক থেকে ৮ কিলোমিটার ভেতরে বাগানটির অবস্থা।
সিরাজুল করিম বিপ্লব পেশায় একজন ব্যবসায়ী। বর্তমানে উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথেও সক্রিয় তিনি। ব্যবসা আর রাজনীতির পাশাপাশি তিনি নিজ উদ্যোগে চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার লালানগর ইউনিয়নের জাইতছড়ির পাহাড়ে বানিজ্যিকভাবে গড়ে তুলেছেন বিষ মুক্ত বিভিন্ন জাতের মিশ্র ফলজের এ বাগান।
সিরাজুল করিম বিপ্লব রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ১৫ নং লালানগর ইউনিয়নের ৬ নং ওয়ার্ডের আকবর সিকদার পাড়া গ্রামের মৃত আবদুস সত্তারের পুত্র। পেশায় ব্যবসা ও রাজনীতিবিদ হলেও কৃষি খামারের প্রতি রয়েছে তার প্রবল আগ্রহ ও অদম্য চেষ্টা। দীর্ঘ সাড়ে ৩ বছর ধরে ১০ একর পাহাড়ি জমির উপর তিনি গড়ে তোলেন এই বিশাল ফলজ বাগান। বর্তমানে তার বাগানে ৩০ প্রজাতির ফলজ গাছ রয়েছে।
সরেজমিনে বাগান ঘুরে দেখা যায়, কোনো কোনো গাছে ফুল ফুটেছে। আবার কিছু গাছে আসছে ফল। ৮ থেকে ১০ জন শ্রমিক ব্যস্ত বাগান পরিচর্যার কাজে। বাগানে সেচের জন্য পাইপ বসানো হয়েছে। পাহাড়ের উঁচু জায়গায় পানির লাইন নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাগানের মাঝখানে বাঁধ দিয়ে তৈরী করা হয়েছে ছোট লেক। সেখান থেকে শুকনো মৌসুমে বাগানে পানি দেওয়া হয়।
সিরাজুল করিম বিপ্লবের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয় চট্টগ্রাম প্রতিদিনের। তিনি বলেন, ‘আমি ২০১৬ সালে পেয়ারা, কাঠগাছ ও রেডলেডি পেঁপে ও রাংগোয়াই আম দিয়ে বাগান শুরু করেছিলাম। ২ বছর পর গাছ ও পেঁপে বিক্রি করে যা আয় করেছি সেই টাকা দিয়ে বিভিন্ন প্রজাতির ফলজ চারা রোপন, বাগান পরিষ্কার করা ও সেচের পাইপ লাইন স্থাপন কাজে বিনিয়োগ করেছি। আমার অনেক বড় পরিকল্পনা রয়েছে। আমি বৃহৎ মিশ্র প্রজাতী ও ঔষধী ফলের বাগান করার কাজ হাতে নিয়েছি। জমি লীজ নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি চাই আমার বাগানটি হবে জীবন্ত সংগ্রহ শালা। আমি দেশী-বিদেশী উন্নত ফলের চারা উৎপাদন করে স্বল্প মূল্যে চাষীদের মাঝে ছড়িয়ে দেব। সেপ্টেম্বর মাসের পর থেকে বাজারে দেশীয় ফলের অভাব দেখা যায়। তখন বিদেশী ফলের উপর নির্ভরশীল থাকে ফল বাজার। আমি চাচ্ছি, সারা বছর দেশীয় ফল বাজার সয়লাব করবে এবং বিদেশী ফলের উপর যেন নির্ভরশীল না হতে হয়। আমি বিদেশী ফলই দেশে চাষ করে বাজারে বিদেশী ফলের সরবরাহ বাড়াব। আমাদের যেন আর বিদেশ থেকে ফল আমদানী না করতে হয়, আমরা যেন দেশের ফলই বিদেশে রপ্তানী করতে পারি।’
তিনি বলেন, ‘মাল্টা মিষ্টি ও হালকা টক জাতীয় সু-স্বাদের নানা পুষ্টিগুণে ভরা একটি ফল। কলবি মাল্টা গাছ লাগানোর এক বছরের মধ্যে ফল আসা শুরু করে। ৪ মাসের মধ্যে তা খাওয়ার উপযোগী হয়। গাছের সঠিক পরিচর্যা করলে ২০-২৫ বছর পর্যন্ত ফল পাওয়া যায়। প্রতি কেজি ফল ১০০-১২০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। এ সব ফল চাষ করতে প্রতি খুটিতে জৈব সার দিতে হয় ২ কেজি, গবর সার দিতে হয় ১৫ কেজি। চারা মাটির সাথে লেগে গেলে পটাশ, ইউরিয়া, জিপসামসহ বুরণ সার দিতে হয় পরিমান মত।’
তিনি আরও জানান, ‘বাগানের প্রধান সমস্যা হলো যাতায়াতের সমস্যা। উপজেলার সাথে যোগাযোগের একমাত্র সংযোগ সড়ক হচ্ছে আকবর সিকদার পাড়া সড়ক। বছরের পর বছর রাস্তাটি বেহাল অবস্থায় রয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সাথে বার বার যোগাযোগ করার পরও রাস্তাটি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। রাস্তার বেহাল দশার কারণে পাহাড়ে উৎপাদিত ফসল ক্রয় করতে বেপারিরা আসতে পারে না। অনুন্নত যাতায়াত ব্যবস্থার কারণে সঠিক সময়ে বাজারজাতের অভাবে প্রতি বছর এখানকার উৎপাদিত কোটি টাকার ফলমূল তরিতরকারি আদা-হলুদ পঁচে নষ্ট হয়ে যায়। যার কারণে রাঙ্গুনিয়ায় কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা থাকলেও লাভের মুখ দেখছে না কৃষকরা। দ্রুত রাস্তাটি সংস্কার করা না হলে কৃষকেরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাছাড়া এখানে বসাবাসরত প্রায় ১০ হাজার মানুষ রয়েছে। এখান থেকে চিকিৎসা নিতে উপজেলা সদরে যাওয়ার পথে অসুস্থ মানুষ এবং গর্ভবতী মহিলাদের ভোগান্তির সীমা থাকে না।’
এ বিষয়ে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা শহিদুজ্জান শাহেদ বলেন, ‘রাঙ্গুনিয়া উপজেলাটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক সম্ভাবনাময় একটি অঞ্চল। এখানকার দুই তৃতীয়াংশ জুঁড়ে রয়েছে বিশাল পাহাড়ী এলাকা। একদিকে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা ভূমি, অপরদিকে অত্র অঞ্চলের পাহাড়ি মাটির প্রতি ইঞ্চিই যেন সোনার মত খাঁটি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে রাঙ্গুনিয়া উপজেলায় প্রায় তিন শতাধিক একর জমিতে আম, ড্রাগন, মালটা, কমলা, লেবু, পেয়ারাসহ শতাধিক প্রজাতীর মৌসুমী ফসলের চাষ ব্যাক্তি উদ্দ্যেগে শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যেই তারা বাগানের ফল বিক্রি শুরুও করে দিয়েছেন। প্রচুর লাভবান হচ্ছে এ অঞ্চলের কৃষকরা। আমরা তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছি। আশা করি অল্প দিনেই অত্র অঞ্চলটি কৃষি জোন হিসাবে দেশে ও বিদেশে পরিচিতি লাভ করতে সক্ষম হবে।’
এমএফও